করোনার সংক্রমণ তেমন একটা নেই। তাই ঈদ উদযাপনেও নেই কোনো ধরণের বিধিনিষেধ। যার যার মতো সবাই আনন্দে মাতবেন। নির্বিঘ্ন ঈদ উদযাপনের মধ্যে বাড়তে পারে সড়ক দুর্ঘটনাও। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে মোটরসাইকেল। দ্রুতগতির এই বাহন ‘সড়কের আপদ’ হয়ে দেখা দিয়েছে। ঈদের আগে-পরে অন্তত ১০ দিন সড়কে বাড়তি যানবাহনের চাপ থাকে। ঢাকাসহ বড় বড় শহর থেকে স্রোতের মতো মানুষ নাড়ির টানে বাড়ি যাবে, উৎসব শেষে আবার কর্মস্থলে ফিরবে। তাই সড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সড়কে যেমন যানবাহনের চাপ থাকে, ঠিক তেমনি দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ঈদে বাড়ি ফিরতে ভোগান্তির কারণে বাইকে করে দূরপাল্লায় যাত্রার প্রবণতা বাড়ছে। বেসরকারি এক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোজার ঈদযাত্রায় সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার, যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
গত রোজার ঈদে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরবাইকে চড়ে বিভিন্ন জেলায় গেছে। আর এই সময়ে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের প্রাণ গেছে। গত বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে ১৪ দিনে দেশে ২৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণ যায়, আহত হয় কমপক্ষে দেড় হাজার। এই হিসাবে মোট দুর্ঘটনার ৪৫.২২ শতাংশ মোটরসাইকেলের। আর মোট মৃত্যুর ৪১.৪৮ শতাংশ ঘটেছে এ দুই চাকার বাহনের দুর্ঘটনায়। অর্থাৎ, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৪৮ শতাংশই ছিলেন হয় মোটরসাইকেলের চালক, নয়তো আরোহী। মোটরসাইকেল আরোহী যেন দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা রীতিমতো কপালে চোখ ওঠার মতো।
এই প্রেক্ষাপটে গত ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঈদের আগে-পরে সাত দিন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। এ সময় আন্তঃজেলায়, অর্থাৎ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মোটরসাইকেল যাতায়াত করতে পারবে না, এমনকি রাইড শেয়ারিংও করা যাবে না। পদ্মা সেতুতেও মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর সাময়িক সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা এখনো বলবত আছে।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৮৬টি। এর মধ্যে ১৭৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৯৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
অন্যান্য দেশে মোটরসাইকেল গণপরিবহন হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে মোটরসাইকেলকে চালকেরা গণপরিবহন হিসেবে দেখেন। তবে এই বাহনগুলো সাধারণত দূরের যাত্রায় ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক এ কারণে যে, এর নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে চালক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মহাসড়কে বাইক দুর্ঘটনা হয় প্রাণঘাতী। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এবারের ঈদে ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব বলেও মনে করা হয়। পরিসংখ্যান বলছে, করোনা-সংকটে গত দুই বছরে দেশের পরিবহনের বহরে ১০ লাখ মোটরসাইকেল নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল, যা দেশের যানজট ও জনজট প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে! এবারের ঈদে জাতীয় মহাসড়কে এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এসব মোটরসাইকেলে স্ত্রী-সন্তান, লাগেজ-ব্যাগেজ নিয়ে ভারসাম্যহীন অবস্থায় বেপরোয়াভাবে বাস-কারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহনব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মোটরসাইকেল সংস্কৃতি চরমভাবে বেড়েছে। এসব মোটরসাইকেল চালক সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছেন। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে। তবে বাইক নিয়ন্ত্রণ করলেই যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, এমন ধারণার কারণ নেই। মনে রাখা প্রয়োজন, অন্য যানবাহনও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কম দায়ী নয়। তাই সব যানের প্রতিই নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সড়ক-মহাসড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেল চলাচল নিরুত্সাহিত করা প্রয়োজন। অপ্রাপ্তবয়স্করা যাতে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে, সে জন্য কঠোর আইনি পদক্ষেপ দরকার। লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন যেন বাইক চলাচল বন্ধের সুযোগ নিয়ে মহাসড়কে উঠতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
দুর্ঘটনা রোধে প্রতিটি সড়কে কঠোর নজরদারির বিকল্প নেই। জনবল বাড়িয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে। যানবাহনে শৃঙ্খলা আনতে সড়কে বসাতে হবে সিসি ক্যামেরা। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যানজট। ঈদের সময় পণ্যবাহী যেসব যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার কথা, সেগুলো যেন কোনোভাবেই রাস্তায় দেখা না যায়। অনুমোদনহীন তিন চাকার সব ধরনের নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল পুরোপুরি ঠেকাতে হবে। এসব কম গতির যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। লাইসেন্সবিহীন চালক এবং এসব পরিবহন চলতে দিয়ে কোনো অবস্থায়ই সড়ক নিরাপদ করা যাবে না। সরকারের উচিত গণপরিবহন বাড়িয়ে সেবার মান উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করে মোটরসাইকেল নিরুত্সাহিত করা অতি জরুরি। এবারের ঈদযাত্রা নিরাপদ ও স্বস্তির হোক।