“ছোট্ট নদীটি পটে আঁকা ছবিটি, একটু হাওয়া নাই জল যে আয়না তাই ঝিম ধরেছে ঝিম ধরেছে গাছের পাতায়, পাল গুটিয়ে থমকে গেছে ছোট্ট তরীটি, আহা ছোট্ট তরীটি।”
দাদীর কাছে শেখা এটিই ছিলো আমার প্রথম গান। দাদীর গানের গলা যে এত চমৎকার! একটা সময় আমার প্রচুর আফসোস হতো, সুযোগ থাকলে দাদী হয়তো বিখ্যাত একজন কণ্ঠশিল্পী হয়ে উঠতে পারতেন।
ছোটবেলা থেকে আমি বড় হয়েছি একটা ছিমছাম সাংস্কৃতিক আবহে সেইসাথে আমাকে শেখানো হয়েছিলো বড় সুন্দর করে সচেতন চর্চায় চর্চিত প্রমিত বাংলা ভাষা এবং শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা। পড়তে বসে কোনো লাইনে ভুল উচ্চারণ করলে দাদী সাথে সাথে ধরিয়ে দিতেন পাশের ঘরে বসেও।
বাচ্চাকাল থেকেই আমি ঘুমাতাম দাদীর কাছে, তাকে চিনেছি প্রতিনিয়ত একটু একটু করে। কত অজানারা ছিলো আমার তাকে নিয়ে সেসব আস্তে আস্তে খোলাসা হয়েছে তারই গল্পে, কথায়, গানে। রাতে দাদী শোনাতেন গল্প তবে সেসব কোনো রুপকথার বানানো কেচ্ছা কাহিনী নয়। সমস্তই তার ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা, সংসার জীবনের সংগ্রাম, যুদ্ধের দাবানল ভয়াবহ সময়, দাদুর স্মৃতি সমস্ত নিয়ে। এক গল্প একশোবার শুনেও বিরক্ত হতাম না কখনো বরং নিজেই বলতাম দাদীকে আবার বলার জন্য। শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে যেতাম সে হদিস ছিলো না।
প্রতিদিন ভোরে দাদী নামাজ পড়তে উঠে যেতেন তারপর অনেকসময় নিয়ে তেলওয়াল করতেন কোরআন শরীফ। এত সুমধুর সুরে দাদী পড়তেন আর সেই ছোট্ট আমি মোহিত বনে ঘাপটি মেরে পড়ে থেকে শুনতাম। দাদী তেলওয়াত শেষ করে আমার পাশে আসতেন মাথা সাপটে দিয়ে তিনবার ফুঁ দিতেন। আলসেমি জড়ানো আমাকে ঘুম থেকে তুলতে দাদীর কত চেষ্টা! ছড়া কেটে কেটে মদনমোহন তর্কালঙ্কার এর লাইনদুটি বলতেন; ” উঠ শিশু মুখ ধোও, পর নিজ বেশ আপন পাঠেতে মন কর হে নিবেশ।”
আমি তর্কালঙ্কারকে চিনতাম না, কেবল চিনতাম আমার দাদীকে। গল্পে গল্পে তার কাছেই তো প্রথম জেনেছি মদনমোহন, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, রবীঠাকুর আর কাছারিবাড়ির কতশত কাহিনী, নজরুলের গজল, বিদ্রোহী কবিতা, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর “কাজলা দিদি”, ” জন্মভূমি”। জসীমউদ্দীনের “আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও” পড়তে গিয়ে দাদী যখন আওড়াতেন;
“আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে। ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে, সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানীদের চলে। পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার, বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর। খোসমানী আর আসমানী যে রয় দুইটি দেশে, কও তো যাদু, কারে নেবে অধিক ভালবেসে?”
শুনতে শুনতে অতখানি মন আর ছোট্টবুকে কেমন চিনচিনে দু:খ জমে উঠতো আমার। কতরাত ফুঁপিয়ে কান্না করলে দাদী কোলের মধ্যে নিয়ে বলতেন, একটা গান গা তো সোনা। একটু বড় হয়ে বুঝতে পারলাম দাদী কেনো গান গাইতে গাইতে অমন কাঁন্না করে ফেলেন! নিজের সমস্ত দু:খ, ব্যথিত হৃদয়ের আহাজারি প্রকাশের জন্যই বোধহয় দাদীর অবলম্বন ছিলো গান, গজল আর জায়নামাজ। বুকের ভেতর তোলপাড় আর ভাংচুর নিয়ে মানুষ বিবাগী হয়ে যায় জানতাম তবে অমন কষে সংসারের হালও যে ধরা যায় তা আমি জেনেছি তাকে দেখে।
জীবনটাকে যুদ্ধের ময়দানে ঢালাও করে বিছিয়ে যে যন্ত্রণার ফিরতি গান গেয়ে ফেলতে পারে সেও আমি জেনেছি। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি বাসায় কয়েকজন অতিথি এসেছেন কুষ্টিয়া থেকে। দাদীকে পায়ে হাত রেখে সালাম করে বললেন, “আমাদের শিক্ষিকা”। সেই প্রথম আমি জেনেছিলাম দক্ষিণ সারুটিয়ায় দিঘীর পাড়ে যে স্কুলটির গোড়াপত্তন করেছিলেন আমার দাদু তখন সেই সদ্য কাঁচাস্কুলটিতে একজন এবং একমাত্র শিক্ষিকা ছিলেন আমার দাদী।
আমি বাস্তবে কোনোদিন বইয়ে পড়া কোনো মহীয়সীর সান্নিধ্য পাই নি তবে এখন এসে বুঝতে পারি যে জলজ্যান্ত মানুষটির ছায়া আমি পেয়েছি তাকে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আখ্যায়িত করার সাহস নাই। সন্ধ্যাবাতিতে সলতে তুলে নিভু আলোতে যে মুখখানি আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তা আমার পরানের গহীনে গেঁথে আছে। মাঝরাতে যখন হুট করে ঘুম ভেঙে দেখি দাদী গাইছে: “আমি অপার হয়ে বসে আছি ও হে দয়াময় .. পাড়ে লয়ে যাও আমায়! আমি একা রইলাম ঘাটে ভানু সে বসিলো পাটে, আমি তোমা বিনে ঘোর সংকটে না দেখি উপায় .. পাড়ে লয়ে যাও আমায়।”
তখন আমি নিজের ভেতরে দাদীকে খুঁজতে থাকি। অমন করে কেনো গায় দাদী! তবে কি প্রখর দহনে শুদ্ধ হলে পরেই মানুষ অমন দরদী হয়ে ওঠে? অমন সরল আশ্রয় চায় অনন্ত অসীম প্রেমময়ের কাছে!