শ্রীলঙ্কায় এই মুহূর্তে যে নজিরবিহীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে তাতে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ ভারত কেন আরও সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না – তা নিয়ে নানা মহলেই প্রশ্ন উঠছে।
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে ভারত গত রোববারও (১০ই জুলাই) যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে দেশটির মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথাই বলা হয়েছে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা এমন কী সে দেশের পার্লামেন্টের প্রতিও সমর্থন জানানো হয়নি। খবর বিবিসি বাংলার।
দিল্লিতে একাধিক বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, শ্রীলঙ্কাকে মানবিক বা অর্থনৈতিক সাহায্য করলেও নানা কারণেই ভারতের পক্ষে সে দেশের রাজনীতিতে জড়ানো সম্ভব নয়, আর সামরিক হস্তক্ষেপের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
আসলে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক – দুদিক থেকেই শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত। অনেকে বলেন ‘একমাত্র প্রতিবেশী’।
সেই শ্রীলঙ্কায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ বিক্ষুব্ধ জনতা দখল করে নিচ্ছে, মানুষ চাল-ডাল-তেল-পাঁউরুটি বা জ্বালানি না-পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে – আর ভারত কিছু ত্রাণ পাঠানো ছাড়া কার্যত হাত গুটিয়ে বসে আছে, ২০-৩০ বছর আগে হলে যা হয়তো ভাবাই যেত না।
কিন্তু পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত এখন রুটিন বিবৃতি দিয়েই দায় সারছে – এবং এটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কলম্বোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দিল্লিও দ্বিধা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তারা এখনই কোনো কমিটমেন্টে যেতে চায় না।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও শ্রীলঙ্কায় ভারতের প্রাক্তন হাইকমিশনার নিরুপমা মেনন রাও বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, আজকের শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাটাই দস্তুর। দেশটা কোন পথে যাবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্তের ঐকমত্য নেই। কী ধরনের সর্বদলীয় সরকার হতে পারে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না – অথচ আইএমএফ বেইল আউটের প্রধান শর্ত ওটাই।
তিনি বলেন, আর ভারতের মুশকিলটা হল, শ্রীলঙ্কায় যা ঘটে তা শুধু সেখানেই আটকে থাকে না, তার ধাক্কা আমাদের ওপরেও এসে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, ভারত শ্রীলঙ্কাতে দারিদ্রসীমার আশপাশে থাকা মানুষজনের জন্য কোনো আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ দেওয়ার কথা।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম বা ওই জাতীয় সংগঠনের মাধ্যমেই সেটা করতে হবে বলে জানান নিরুপমা রাও মেনন।
কলম্বোর রাজনৈতিক গতিপথ কোন দিকে যাচ্ছে বা কারা আগামী দিনে দেশের কর্তৃত্ব নিতে পারে, তা নিয়ে এই মুহূর্তে ভারতের ধারণা যে খুব স্বচ্ছ নয় সেটা অবশ্য পরিষ্কার।
দিল্লিতে পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ ও শ্রীলঙ্কা পর্যবেক্ষক সুরেশ কে গোয়েলের মতে, ভারতের সেটা আন্দাজ করারও কোনো দরকার নেই – বরং শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাতে গেলে ভারত বিরাট ভুল করবে।
গোয়েল বলেন, সেখানকার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে ভারতের পুরোপুরি দূরে থাকা উচিত – নইলে কিন্তু ভারতও চীনের মতো একই ধরনের বিপদে পড়বে। চীন এক সময় শ্রীলঙ্কাতে খুব অ্যাক্টিভ ইন্টারেস্ট দেখিয়েছিল, এখনও হামবানটাটো বন্দরের পরিচালনার রাশ তাদেরই হাতে – কিন্তু বর্তমান সঙ্কটে তারা কোনো সক্রিয়তা দেখাচ্ছে না বললেই চলে, বরং খুব সাবধানে পা ফেলছে।
গোয়েলের মতে, শ্রীলঙ্কার মানুষ চীনের ওপর ক্ষেপে আছে। তবে ভারতের সাহায্যও মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমিত রাখা উচিত হবে।
কোনো রাজনৈতিক বার্তা দিতে গেলে ভারত কিন্তু শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ককেই হুমকির মুখে ফেলবে, যোগ করেন তিনি।
ঠিক ৩৫ বছর আগে এই জুলাই মাসেই শ্রীলঙ্কায় শান্তিরক্ষার নামে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল ভারত – তামিল টাইগারদের নিরস্ত্র করার মিশন নিয়ে গেলেও ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্সের (আইপিকেএফ) সেই অভিযান চরম ব্যর্থতার মুখে পড়ে, নিহত হন শত শত ভারতীয় সেনা।
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিবিদ ভাস্বতী মুখার্জি বলেন আজকের যুগে সেরকম কোনো পদক্ষেপ কিন্তু ভাবাই হবে না।
মুখার্জির কথায়, তখনকার প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আইপিকেএফ পাঠিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট জয়াওয়ার্ধনের অনুরোধে।
তবে সেটা ছিল শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। তখন ভারত ভেবেছিল তামিলরা তাদের ভূমিকা গ্রহণ করবে।
কিন্তু ঘটনাটা একদম উল্টো হলো, শেষে তো এলটিটিই-র হাতে রাজীব গান্ধীকে প্রাণই দিতে হলো, মুখার্জি বলেন।
তিনি বলেন, ১৯৮০র দশকের সেই ‘তিক্ত অভিজ্ঞতার’ পর আর কোনো ভারতীয় সরকার কখনো শ্রীলঙ্কায় সেনা পাঠানোর কথা ভাববে না।
ফলে পাশের দেশ শ্রীলঙ্কা উথালপাথাল ঘটে গেলেও ভারতকে এখন জাহাজভর্তি ত্রাণ পাঠানোর কথাই ভাবতে হচ্ছে – প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে আইএমএফ বা সম্ভাব্য দাতা দেশগুলোকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ডোনার কনফারেন্স আয়োজনের।
শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অন্তত প্রকাশ্যে যে তারা কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না – সেটা দেখানোর জন্য দিল্লির চেষ্টাও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।