- সিলেট বিভাগে বন্যায় ২২ জনের মৃত্যু
- অনাহারী লোকের সংখ্যা বাড়ছে
- গ্রামের হাটবাজার না থাকায় সামর্থ্যবানরাও কিছু কিনে খেতে পারছেন না
সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ বন্যার আগ্রাসী থাবায় বিপর্যস্ত জীবন। কোথাও প্রাণচাঞ্চল্য নেই। বানভাসি এলাকায় অনাহারী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। লাখো মানুষ এখনও উদ্ধারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা অপ্রতুল। গ্রামের হাটবাজার না থাকায় সামর্থ্যবানরাও কিছু কিনে খেতে পারছেন না। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় শহর থেকে মালামাল নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। চারদিকে পানি আর পানি। ঘরে-বাইরে সব একাকার। পানিবন্দীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। যেখানে একটুকরো শুকনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই মাথা গোঁজার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন স্থানে সড়কের শুকনো জায়গার ওপর মানুষ তাঁবু ও ডেরা টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। নিজের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন সত্ত্বেও সঙ্গে গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগিগুলোও আগলে রাখার চেষ্টা করছেন অনেকে। ট্রাক-বাস, পিকআপের ওপর তাঁবু টানিয়ে বিপদ সংকুল সময় অতিবাহিত করছেন।
গত তিনদিন ধরে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সিলেটের সুরমা, ধলাই, পিয়াইন, সারি ও লোভা তীরবর্তী উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এবার বৃদ্ধি পাচ্ছে কুশিয়ারা নদীর পানি। কুশিয়ারা নদীর ডাইকের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। ভাঙ্গন ও ডাইক উপচে পানি ঢুকে ছয়টি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। উপজেলাগুলো হচ্ছে- জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর ও গোলাপগঞ্জ।জানা গেছে, দুদিন কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছিল ধীর গতিতে। কিন্তু গত রবিবার থেকে অস্বাভাবিক গতিতে পানি বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হয়। ফলে রবিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত কুশিয়ারা তীরবর্তী উপজেলাগুলোর বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এক মাস পূর্বের বন্যার সময় যে সব স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল, তার পাশাপাশি নতুন নতুন স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ডাইকের ওপর দিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করা শুরু করেছে। ফলে কুশিয়ারা তীরবর্তী উপজেলাগুলোতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এসব উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। কুশিয়ারা তীরবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জকিগঞ্জ উপজেলার ৩৯টি স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ করছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে সুলতানপুর ইউনিয়নের ভক্তিপুর, সদর ইউনিয়নের রারাই, বীরশ্রীর সুপ্রাকান্দি, কাজলসারের বড়বন্দ এলাকায়। বর্তমানে উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে আরও ভাঙ্গনের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদী ও তীরবর্তী এলাকা পানিতে একাকার হয়ে গেছে। বানের পানিতে উপজেলা সদরসহ ৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বালাগঞ্জ উপজেলার অবস্থাও একই। কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙ্গে ও ওপর দিয়ে পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয়েছে বাড়িঘর, হাটবাজার ও রাস্তাঘাট। বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে বালাগঞ্জ-খছরুপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিয়ানীবাজার উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার চারখাই, আলীনগর, শেওলা, দুবাগ, কুড়ারবাজার ও থানাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। উপেজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। ওসমানীনগর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। উপজেলার গোয়ালাবাজার, তাজপুর, দয়ামীর, বুরঙ্গা, সাদিপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, উসমানপুর ও উমরপুর ইউনিয়নের পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গেছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সময় সময় বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটছে।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুরমা তীরবর্তী বাঘাসহ কয়েকটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে, কুশিয়ারা তীরবর্তী এলাকায় অবনতি হয়েছে। উপজেলার শরীফগঞ্জ, বাদেপাশা, ঢাকাদক্ষিণ, আমুড়া ও ভাদেশ^র ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। পানি বৃদ্ধি পেয়ে কুশিয়ারা তীরবর্তী ইউনিয়নগুলোর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদিকে, সুরমা তীরবর্তী সিলেট নগরী, সদর, বিশ্বনাথ ও কানাইঘাট উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সিলেট নগরীর উঁচু এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। নদী তীরবর্তী এলাকায় এখনও লাখো মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। বাকি উপজেলাগুলোতেও লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। ধলাই, পিয়াইন, সারি ও লোভা নদীর পানি কমায় জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার পানি কিছুটা কমেছে। তবে, পানি কমার গতি খুবই ধীর বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এই তিন উপজেলার এখনও ৯০ ভাগ এলাকা প্লাবিত রয়েছে।
বন্যায় তলিয়ে গেছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার প্রায় শতভাগ এলাকা। বন্যার পানি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কোম্পানীগঞ্জের অতীত রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। জানা গেছে, নৌকার অভাবে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পারছেন না। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় কোন ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন না মানুষ। এদিকে, আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের সঙ্কুলান হচ্ছে না। উপজেলার উঁচু বিল্ডিংগুলোতে ব্যক্তি উদ্যোগে চালু করা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। সরকারীভাবে আশ্রয়কেন্দ্র-গুলোতে পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার ভোলাগঞ্জ আরাবিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা, পাড়ুয়া আনোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয় এ্যান্ড কলেজ ও স্কুলগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে চালু করা হয়েছে। এ ছাড়াও দয়ার বাজার, পাড়ুয়া সাকেরা এলাকায়ও ব্যক্তি উদ্যোগে চালু হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। এলাকাবাসী এগুলোতে খাবার জোগান দিচ্ছেন। তারা সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান।বন্যায় প্লাবিত সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা। উপজেলার শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে গৃহবন্দী আছেন উপজেলার প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ। গত ১৬ জুন রাত থেকে উপজেলা সদরের সঙ্গে সকল ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। নেই বিদ্যুত ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সকল রাস্তাঘাট। প্লাবিত হয়েছে বাড়িঘর, হাটবাজার, গুচ্ছগ্রাম, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পানিবন্দী পরিবারের মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অনেক ঘরে পানি প্রবেশ করায় খাবার রান্না করা তো দূরের কথা, পরিবারের সদস্যদের বিশ্রামের জায়গা নেই। এই ভয়াবহ অবস্থায় মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। রয়েছে তীব্র খাবার সঙ্কট। খাবারের জন্য আর্তনাদ করছেন বন্যাকবলিত মানুষ। বিশ্বনাথ পৌরশহরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে বন্যার্তরা কিছু ত্রাণ সহায়তা পেলেও বঞ্চিত রয়েছেন উপজেলার খাজাঞ্চী, অলংকারী, রামপাশা, দৌলতপুর, দেওকলস ও দশঘর ইউনিয়নের বন্যাকবলিত হাজার হাজার মানুষ। সরকারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিত্তবান লোকজন ও সেবামূলক সংগঠনগুলোর পক্ষ হতে অনেকেই বিশ্বনাথে ত্রাণ নিয়ে আসলেও উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকায় এবং নৌকা না থাকায় প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে দুর্গত মানুষের কাছে তারা ত্রাণ পৌঁছাতে পারছেন না। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হিউমেনিশন রিলিফ প্রোগ্রামের আওতায় ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন অর্গানাইজেশনের পক্ষ হতে সিলেট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া উপজেলার কিছু এলাকায় দুর্গতদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও পৌর প্রশাসক নুসরাত জাহান জানিয়েছেন, গতকাল সোমবার পর্যন্ত উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য ৩০ মেট্রিক টন চাল ও শুকনো খাবারের জন্য ৭ লাখ টাকা সরকারীভাবে বরাদ্দ হয়েছে।
চোর ডাকাতের উপদ্রপ ॥ বন্যাকবলিত এলাকায় সন্ধ্যা হলেই আতঙ্ক শুরু হয়। রাত জেগে পাহারা দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন এলাকাবাসী। এ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। এমনিতেই বন্যার কষাঘাতে জর্জরিত। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, চিকিৎসা নেই। চারদিকে পানি আর পানি। সাপ-বিচ্ছুর ভয়। তার ওপর যোগ হয়েছে ডাকাত-আতঙ্ক। যেন কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। বন্যা যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে চোর-ডাকাতদের জন্য। ডাকাতরা সন্ধ্যা নামলেই গ্রামগঞ্জে নৌকাযোগে হানা দিচ্ছে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লুটে নিচ্ছে মানুষের সহায়-সম্বল। চারদিকে পানি আর পানি। ডাকাতকবিলত মানুষের চিৎকার শুনে কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারছে না।
সিলেট বিভাগে এ পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু ॥ বন্যায় সিলেট বিভাগে এ পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়। অধিফতরের পরিচালক হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘এ পর্যন্ত বন্যায় সিলেট বিভাগে ২০ জনের মৃত্যুর তথ্য আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে সিলেটে ১২ জন, মৌলভীবাজারে তিনজন ও সুনামগঞ্জে পাঁচজন।’ এ ছাড়া মঙ্গলবার সকালে সিলেটের জৈন্তাপুরে মা-ছেলের মরদেহ ভেসে উঠেছে। তাৎক্ষণিক এ দুই মরদেহের তথ্য তার কাছে নেই। তবে, এ তথ্য যোগ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সে অনুযায়ী, বন্যায় সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে সোমবার পর্যন্ত সিলেটের জেলা প্রশাসক একজনের, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তিনজনের ও ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে, স্থানীয় সূত্রে আরও কয়েক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও সত্যতা নিশ্চিত করেনি প্রশাসন। সিলেট ও সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ বন্যা। দুই জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে পানিতে। সোমবার পর্যন্ত পানিবন্দী ছিলেন অন্তত ৪০ লাখ মানুষ। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। বিদ্যুত, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকার কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। বিদ্যুত ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর তথ্য জানা যাচ্ছে। স্রোতে ভেসে যাওয়ার চারদিন পর মঙ্গলবার সকালে সিলেটের জৈন্তাপুর
উপজেলার দরবস্ত এলাকায় পানিতে ভেসে আসে নাজমুন্নেসা (৫০) ও তার ছেলে আব্দুর রহমানের (১৪) মরদেহ। তারা দরবস্ত ইউনিয়নের কলাগ্রামের বাসিন্দা।
কানাইঘাটে হাওড়ে মাছ ধরতে গিয়ে একজন মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার উপজেলার সাতবাক ইউনিয়নের ঠাকুরের ঘাটি এলাকার এক ব্যক্তি হাওড়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। পরদিন পানিতে তার লাশ পাওয়া যায়।’ শুক্রবার মরদেহ উদ্ধার হলেও এ তথ্য জানা গেছে সোমবার। তবে, তার নাম জানাতে পারেননি ওসি। এর আগে সোমবার সিলেটের জেলা প্রশাসক মোঃ মজিবুর রহমান বলেছেন, ‘পানিতে পড়ে যাওয়া সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে একজন মারা গেছেন। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত মৃত্যুর কোন তথ্য আমি পাইনি।’ ডিসি জানান, পানিতে ছিঁড়ে যাওয়া বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়ে গত রবিবার নগরের রায়নগরে নিজ বাসার সামনে মারা গেছেন সিলেট মহানগর যুবলীগ নেতা টিটু চৌধুরী। সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত আজমেরী হক জানিয়েছেন, বন্যায় এ পর্যন্ত তিনজন মারা যাওয়ার খবর তিনি জেনেছেন। এর মধ্যে একজন বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে ও দুজন পানিতে ভেসে গিয়ে মারা গেছেন। এ ছাড়া পানিতে ভেসে যাওয়া একজন এখনও নিখোঁজ আছেন। তিনি জানান, সোমবার সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ থানার নোয়াপাড়া এলাকার নিজ বাসায় বন্যার পানির ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন মনির হোসেন নামে এক যুবক। গত শুক্রবার উপজেলার নলকট গ্রামের কলেজছাত্র আব্দুল হাদি পানিতে তলিয়ে যায়। ওই দিনই তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সে সময় আরও একজন পানিতে তলিয়ে মারা গেছেন। তবে, সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও স্থানীয় একটি কলেজের প্রভাষক সেলিম আহমদ জানিয়েছেন, পানিতে তলিয়ে উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নে আরও দুজন মারা গেছেন। তারা হলেন- ছাত্রলীগ নেতা এ কে আবুল কাশেম (২৪) ও তার
দাদি ছুরেতুন নেছা (১০৫)। তাদের বাড়ি ইউনিয়নের সুজাতপুর গ্রামে। সেলিম বলেন, ‘আবুল কাশেম তার পরিবারের সঙ্গে নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় বসবাস করেন। বন্যার পানি বেড়েছে জেনে গ্রামের বাড়ি থেকে বৃদ্ধ দাদি ছুরেতুন নেছা ও চাচাত বোনকে উদ্ধার করতে বৃহস্পতিবার সকালে একটি নৌকা নিয়ে আসেন। দাদিকে নিয়ে শহরে ফেরার পথে সুজাতপুর আইডিয়াল স্কুল এলাকায় পানির স্রোতে নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় তার ছোট চাচাত বোন উল্টে যাওয়া নৌকা ধরে প্রাণে বাঁচলেও দাদি-নাতি দুজনই পানিতে তলিয়ে যান। শুক্রবার দাদি ছুরেতুন নেছার মরদেহ ভেসে ওঠে। আর রবিবার সকালে আবুল কাশেমের লাশ একই জায়গায় ভেসে ওঠে। তাদের লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তবে এ দুজনের মৃত্যুর বিষয়ে কোন তথ্য পাননি বলে জানিয়েছেন ইউএনও নুসরাত। বন্যার পানিতে তলিয়ে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ছৈলা-আফজালাবাদ ইউনিয়নের রাধানগর এলাকার জুনেদ নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ছাতকের ইউএনও মামুনুর রশীদ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ছাতক পৌরসভার কানাখালী রোডের আখড়া এলাকায় পীযূষ ও জাউয়া বাজার এলাকায় হানিফা বেগম নামে এক স্কুলছাত্রী মারা গেছে পানিতে তলিয়ে। তবে, এই দুই ঘটনা ইউএনও নিশ্চিত করেননি। এ ছাড়া মৌলভীবাজারের বড়লেখা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের আদিত্যের মহাল এলাকায় ঢলের পানিতে তলিয়ে এক শিশু মারা যাওয়ার খবরও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এটিও প্রশাসন নিশ্চিত করেনি।
ত্রাণ নিতে আসা ব্যক্তির মৃত্যু ॥ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় বন্যা দুর্গতদের জন্য হেলিকপ্টারে করে বিমান বাহিনীর দেয়া ত্রানসামগ্রী নিতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে আহত ৬ জনের মধ্যে একজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে গুরুতর আহত বিপ্লব মিয়া (৪৫) মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাহিরপুর উপজেলা সদরের উজান তাহিরপুর গ্রামের শহীদ আলীর ছেলে। নিহত বিপ্লব ২ ছেলে ও ২ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। নিহতের ছোট ভাই আমিরুল ইসলাম জানান, ঘটনার দিন বিপ্লব মিয়া কাঁচা বাজারের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হোন। ফেরার পথে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের সামনে পৌঁছলে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া ত্রাণসামগ্রী বিপ্লবের পিঠের ওপর পড়লে তিনি গুরুতর আহত হন। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরের দিন অবস্থার অবনতি হলে প্রথমে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে এবং পরে সিলেটে নিয়ে গেলে সেখানেই তিনি মারা যান। উজান তাহিরপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মতিউর রহমান মতি মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সোমবার তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন থাকার পর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার সকালে সিলেট নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, সোমবার দুপুরে তাহিরপুর উপজেলা সদরের শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে হেলিকপ্টারের ওপর থেকে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। এ সময় শতাধিক বন্যার্ত শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে ত্রাণ সহায়তা নিতে গেলে ওপর থেকে ছুড়ে দেয়া ত্রাণ বন্যার্তরা সবাই দৌড়াদৌড়ি করে ধরতে গেলে ৬ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) সুহেল রানা বলেন, ত্রাণ বিতরণের জন্য এয়ারফোর্সের একটি হেলিকপ্টার তাহিরপুরে এসেছিল। বন্যার পানির জন্য সদরের কোন স্থানে নামতে না পারায় আকাশ থেকেই তারা ত্রাণের বস্তা মাটির দিকে নিক্ষেপ করেছিল। ত্রাণ গ্রহণ করতে গিয়ে অনেকেই আহত হয়েছেন।
দক্ষিণ সুরমার বিদ্যুতকেন্দ্র নিরাপদ ॥ বিদ্যুত বিভাগের ডিভিশন-৩ এর সুইচ ইয়ার্ড, সাবস্টেশন কন্ট্রোল রুম পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সমগ্র দক্ষিণ সুরমার বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ১৬ জুন বৃহস্পতিবার প্রবল বেগে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায় পুরো সিস্টেম। ২০ জুন সোমবার সকাল থেকেই সেনাবাহিনী কাজ করছে। সেনাবহিনীসহ বিভাগের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। মঙ্গলবার সাবস্টেশন চালু করে বিদ্যুত সরবরাহ করার কথা রয়েছে।
জামালপুরের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, জামালপুর জানান, অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও বকশীগঞ্জ উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। চলতি বন্যায় জেলায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়তে থাকায় জেলার ইসলামপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যমুনা নদীর পূর্বতীর ঘেঁষা ইসলামপুর উপজেলার সাপধরী, নোয়ারপাড়া, বেলগাছা, কুলকান্দি ও চিনাডুলি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এই পাঁচটি ইউনিয়নসহ উপজেলায় অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
মাধবপুরে ৩০ গ্রাম প্লাবিত ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, মাধবপুর জানান, মাধবপুর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ বন্যায় প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। গ্রামের আঞ্চলিক সড়ক ও কাচা রাস্তা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপজেলা প্রশাসন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও চিকিৎসার জন্য আশ্রয় কেন্দ্র ও মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা, ছাতিয়াইন, নোয়াপাড়া, বুল্লা, আদাঐর ও আন্দিউড়া ইউনিয়নের ভাটি এলাকার ৩০টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি এবারের বন্যায় বিগত বছরের সব রেকর্ড ভেঙ্গেছে। সোনাই নদীর খুটানিয়া দিঘীর পাড় সুলতানপুর এলাকার একাধিক স্থানে নদীর পাড় পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
কুড়িগ্রামে ভাঙ্গন কবলিতরা পেল
৫০ হাজার টাকার করে ॥ স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম জানান, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ৯৪ জন উপকারভোগীদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে ৪৭ লাখ টাকার চেক বিতরণ করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় সদর উপজেলা পরিষদ হলরুমে বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিনহাজুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, সদর ইউএনও মোঃ রাসেদুল হাসান প্রমুখ।
নাসিরনগরে ৩০ কিমি সড়ক তলিয়ে গেছে ॥ স্টাফ রিপোর্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে হাওড় বেষ্টিত এই উপজেলার নিম্নঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে প্লাবিত হওয়া এলাকার সংখ্যা। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ তারা সরকারীভাবে কোন ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন না।উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দিন দিন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৩০ কিলোমিটার আধাপাকা-পাকা সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার প্রায় ৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারপাশে পানি উঠেছে।