গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। কাটছে না ডলার সংকটও। কমে যাচ্ছে রপ্তানি আয়, শিল্পের উৎপাদন। থামছে না রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ। বাড়ছে শ্রমিকের বেতন। বৃদ্ধি পেয়েছে সব ধরনের কাঁচামালের দাম। এসব কারণে বেড়ে যাচ্ছে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যয়। যার সরাসরি চাপ পড়ছে ভোক্তার ওপরে। প্রভাব পড়ছে সার্বিক অর্থনীতিতে। প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। শিল্প খাতে এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। সব মিলিয়ে শিল্পকারখানার আকাশে এখন মেঘের ঘনঘটা।
আগের দুই মাসের ধারাবাহিকতায় চলতি মার্চে টানা তৃতীয় দফায় বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছে। তাতে বিদ্যুৎ-নির্ভর শিল্পকারখানায় পণ্যের উৎপাদন খরচ আরেক দফা বাড়বে। এতে অনেক পণ্যই আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হবে ভোক্তাদের।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে একজন ভোক্তার শুধু প্রতি মাসে বাড়তি বিল দিলেই হয় না, বাড়ে তার বাজারের খরচ, জীবনযাত্রার ব্যয়। বিদ্যুতের দাম বাড়া মানে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বাড়তি খরচ যুক্ত হওয়া। কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প সব খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব হবে বহুমুখী। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে, যার মাশুল দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের।
কয়েকটি খাতের উদ্যোক্তারা বলেন, ডলার-সংকটে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে এখনো সমস্যা হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। গত মাসে গ্যাসের দাম একলাফেই ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কায় পণ্য রপ্তানির ক্রয়াদেশ আসার হারও তুলনামূলক কম। সব মিলিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত দুই বছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু এখন রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি নেই। সে কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ কমে আসছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে শিল্পের উৎপাদন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে যেতে পারে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্পের পণ্য আমদানিতেও চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। চাহিদার অর্ধেক ডলারও সরবরাহ করতে পারছে না ব্যাংক। এজন্য কমে গেছে কাঁচামালের আমদানি। কমে গেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, জ্বালানির দাম বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, শ্রমিকের বেতন বেড়ে যাচ্ছে, সব মিলে শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে কাঁচামাল এবং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণেই প্রায় ৩০ শতাংশ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
শিল্পে বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নতুন বছরে নতুন করে কেউ নতুন বিনিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে না। ২০২১ সালে নতুন শিল্পের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ঐসব শিল্পের কাঁচামালসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এখনো দেশে এসে পৌঁছেনি। এছাড়া গ্যাস এবং জ্বালানির অবস্থা স্বাভাবিক না হলে কেউ নতুন করে বিনিয়োগে যাবেন না। বিনিয়োগকারীরা এ বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। বিদ্যুতের সংকটও স্বাভাবিক হচ্ছে না। এখনো গড়ে অনেক জায়গায় প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। তবে গ্রিড লাইন থেকে যারা সরাসরি বিদ্যুৎ নিতে পারছে তাদের লোডশেডিং কম হচ্ছে। তাদের হয়তো দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন স্ট্যাটিস্টিকসের (আইপিএস) তথ্যানুযায়ী, দেশের শিল্প খাতে এক বছরে কাঁচামাল ও অন্যান্য মূলধনি যন্ত্রপাতির ব্যয় ১৩ থেকে ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে শস্য প্রক্রিয়াকরণ, লোহা ও ইস্পাত, দুগ্ধজাত পণ্য, চিনি, পশুখাদ্য, পরিবহন সরঞ্জাম, মোটরসাইকেল, খাদ্য পণ্য, মৌলিক ধাতু, কাঠের আসবাবপত্র, ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ খাতে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বেড়েছে। আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রডিউসার প্রাইজ ইনডেক্স (পিপিআই) প্রতিবেদনে স্থান পাওয়া ৮৮ পণ্যের মধ্যে ৭০টির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে এরই মধ্যে ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন খরচ ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। কারণ একই সময় কাঁচামালের দামও বেড়েছে। তারা জানান, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মূলত স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করে, পাশাপাশি রপ্তানিতেও কিছুটা ভূমিকা রাখে। পুঁজি কম এবং সঞ্চয় সীমিত হওয়ায় উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষমতাও কম। ফলে হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো। শিল্পকারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সুতা, তুলার দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। যে কারণে বাড়ছে উৎপাদন খরচও। তবে এ মুহূর্তে শিল্পোদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া।
জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সামির সাত্তার ইত্তেফাককে বলেন, এভাবে যদি প্রতি মাসেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্পকারখানায় পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। পণ্য রপ্তানির সক্ষমতায় প্রভাব ফেলবে। মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। এতে শিল্পকারখানার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পাবে। তিনি বলেন, ভর্তুকির চাপ সামলাতে আমাদের এখন স্বল্প মেয়াদে সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে গড়ে সব শিল্পের পণ্য উৎপাদন ব্যয় আরও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়ে যাবে।