বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নানা রকম সমস্যা আছে। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় দেশ শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের সামষ্টিক অর্থনীতির যে সমস্যা, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্যা মেলানো ঠিক হবে না। কারণ এদের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান বা সৃষ্ট সমস্যা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমস্যা অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। আমরা যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখব, আইএমএফ ঋণদানের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে, পাকিস্তান তা পরিপালন করতে পারছে না। ফলে পাকিস্তান আইএমএফ থেকে প্রত্যাশিত ঋণ আদৌ পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ এতটাই কমে গেছে যে, তা দিয়ে দেশটির ১৪/১৫ দিনের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা বেশ ভালো। বাংলাদেশ এখনো যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণ করছে, তা দিয়ে কয়েক মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই সার্ক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণ করছিল। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। এখন রিজার্ভের পরিমাণ অনেকটা কমে গেলেও তা উদ্বেগজনক নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যান্য সূচকও পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং উন্নয়নশীল অনেক দেশের তুলনায় ভালো আছে।
আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করব, বাংলাদেশ যখন আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করে তখন সংস্থাটি অত্যন্ত স্বল্পসময়ের মধ্যে ঋণ প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াকরণ করে তাদের বোর্ড সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। আইএমএফ ধরে নিয়েছে যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে নয়। পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যেমন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমনটি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিমত্তা তারা লক্ষ করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে; কিন্তু তা খুবই সাময়িক। তাই সংস্থাটি আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কিছুটা টানাপড়েন দেখা দিয়েছে, কিন্তু তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। বা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিকে স্বাভাবিক রাখার জন্যই মূলত আইএমএফ এই ঋণ দিয়েছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ সঠিক সময়ে আইএমএফের কাছে থেকে ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইএমএফের এই ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট টানাপড়েন কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এই ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে এবং যে ত্রুটিবিচ্যুতি আছে তা দূর করতে সহায়তা করবে।
আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে, তার পরিমাণ কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। তারা ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। এই ঋণ তারা একবারে ছাড় করবে না। মোট সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এই ঋণ ছাড় করা হবে। আইএমএফের এই ঋণ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্ফীত করার ক্ষেত্রে খুব একটা অবদান রাখবে না, এটা সত্যি। আইএমএফ ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করার ক্ষেত্রে কোনো শর্ত দেয়নি। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়করণের আগে তারা পর্যালোচনা করবে, বাংলাদেশ করণীয়গুলো পরিপালনের ক্ষেত্রে কী করেছে। তাদের দেওয়া শর্ত পরিপালনে বড় ধরনের কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়করণ করবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে তারা ঋণের সবগুলো কিস্তি ছাড় করবে। তবে ঋণগ্রহীতা দেশ যদি তাদের দেওয়া শর্ত ও পরামর্শ পরিপালনে ব্যর্থ হয় অথবা অনাগ্রহ প্রদর্শন করে তাহলে ঋণের কিস্তি মাঝপথে বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এটাই আইএমএফের নিয়ম। আইএমএফের দেওয়া এসব শর্ত বা পরামর্শ আমাদের অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টকে উন্নত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করার পর পরবর্তী ছয় মাসে আমরা যদি তাদের দেওয়া শর্তগুলো পরিপালন করি, তাহলে দেখা যাবে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। আইএমএফের শর্ত পরিপালনের ফলে অর্থনীতি যদি পুনরুজ্জীবিত হতে শুরু করে, তাহলে আমরা সহজেই ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেয়ে যাব। এই ঋণ আমাদের অর্থনীতিকে আরো উত্তরণের পথে নিয়ে যাবে। অর্থনৈতিক উত্তরণ প্রক্রিয়া তো একবারে সম্পন্ন হবে না। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে এই উত্তরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আইএমএফের ঋণ এবং তার সঙ্গে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের অর্থনৈতিক উত্তরণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন আইমএফ, বিশ্বব্যাংক এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে যখন ঋণ সহায়তা গ্রহণ করা হয়, তখন তাদের দেওয়া কিছু শর্ত মেনে নিতে হয়। পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এসব শর্ত মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার করেই ঋণ সহায়তা পাওয়া যায়। আইএমএফ ঋণ দানের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দিয়েছে তার অনেকগুলোই অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। আর কিছু শর্ত আছে যেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে আমাদের অর্থনীতির জন্য কিছুটা হলেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। আমরা যেভাবে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই তার সঙ্গে এসব শর্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না সেটাই বড় প্রশ্ন। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে এর অধিকাংশই বাস্তবসম্মত এবং আমাদের অর্থনীতির জন্য আবশ্যক। এতদিন এসব শর্ত পরিপালন করা হয়নি। এখন আইএমএফের শর্তের কারণে এসব সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। একটি দেশের অর্থনীতি যখন গতিশীল ধারায় চলমান থাকে তখন সেখানে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের একটি প্রবণতা হচ্ছে অর্থনীতিতে যখন কোনো দুর্বলতা বা সমস্যা দেখা দেয়, সঙ্গে সঙ্গে আমরা তা দূর করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করি না। ফলে এসব সমস্যা বা দুর্বলতা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। একসময় তা বিরাট আকার ধারণ করে। এই পুঞ্জীভূত সমস্যা বা দুর্বলতা একসময় অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। তখন আমাদের নিজেদের এসব সমস্যা দূর করার জন্য উদ্যোগ নিতে হয়। অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের সহায়তা নিয়ে এসব সমস্যা দূরীকরণের জন্য চেষ্টা করা হয়। যেহেতু সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে, তাই তা সমাধান করতে গেলে কিছু লাভক্ষতি হয়ে থাকে। তবে সমস্যা পুঞ্জীভূত হওয়ার ফলে তা সংস্কার করতে গেলে লাভক্ষতির পরিমাণটা বেশি হয়। হয়তো উপযুক্ত সময়ে এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলে অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব কম হতো। কাজেই ভবিষ্যতে যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পরপরই তা সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করার জন্য আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই সময়ে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ প্রতিষ্ঠিত হলেও এ দুটি সংস্থার ম্যান্ডেট ভিন্ন। আইএমএফের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও রক্ষা করা। আর বিশ্বব্যাংকের মূল ম্যান্ডেট হচ্ছে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসাধনে সহায়তা করা। কাজেই আইএমএফ যখন কোনো দেশকে ঋণ প্রদান করে তার উদ্দেশ্য থাকে দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কাজেই আইএমএফ ঋণদানের আগে সংশ্লিষ্ট দেশটির অর্থনীতি বিশেষভাবে পর্যালোচনাপূর্বক প্রাপ্ত সমস্যাগুলো দূরীকরণের মাধ্যমে কীভাবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায় সেই চেষ্টা করে। মূলত এ কারণেই আইএমএফ ঋণ সব সময়ই শর্তযুক্ত হয়ে থাকে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতে কোনো না কোনো সময় টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। এই টানাপড়েন দূর করার জন্য আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তার প্রয়োজন আছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের উদ্দেশ্যই হচ্ছে সদস্য দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। মূলত এই উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠান দুটি সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হবে আমাদের নিজস্ব শর্তে ঋণ গ্রহণ করা, যা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে উত্সাহিত করবে।
ব্যাংক দেশের সাধারণ নাগরিকদের থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে। নাগরিকগণ তাদের সাংসারিক চাহিদা পূরণের পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে তা ব্যাংকে সংরক্ষণ করে—এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেশে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের সাংসারিক ব্যয় অনেকটাই বেড়ে গেছে। তারা ইচ্ছে করলেও আয়কৃত অর্থ হতে ব্যাংকে আমানত রাখার মতো উদ্বৃত্ত অর্থ সৃষ্টি করতে পারছেন না। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এখন আগের মতো সঞ্চয়ের সামর্থ্য অর্জন করতে পারছেন না। ফলে তারা ব্যাংকে আগের মতো আমানত সংরক্ষণ করতে পারছেন না। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আগে ব্যাংকে রক্ষিত আমানত ভেঙে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছেন। আমাদের দেশে করোনাকালের বিষয়টি মনে রাখতে হবে। সেই সময় অনেকেই তাদের কর্মসংস্থান হারিয়ে আর্থিকভাবে প্রচণ্ড দুরবস্থার মধ্যে পতিত হন। যারা করোনাকালে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন তারা এখনো পুরোপুরি আর্থিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। করোনা-উত্তর সময়ে দেশের অর্থনীতি যখন কিছুটা উত্তরণের পথে ছিল তখনই শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা দেখা দেয়। প্রতিটি জিনিসপত্রের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। একদিকে মানুষের আয় কমে যায় পাশাপাশি পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। সবকিছু মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি এবং আয় হ্রাসের প্রেশারটা কিন্তু রয়েই গেছে। সাধারণ মানুষের এই দুরবস্থা ব্যাংক আমানতের ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষ এখন চাইলেই আগের মতো আমানত সংরক্ষণ করতে পারছেন না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা আগের আমানত উত্তোলন করে সাংসারিক প্রয়োজনে ব্যয় করছেন। কিন্তু ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। করোনা-উত্তর দেশের অর্থনীতি আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে বিপরীতমুখীপ্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। আমানতের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব এবং ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে চাঙ্গা অবস্থা লক্ষণীয়। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, কোনো অর্থনীতি যখন বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় থাকে তখন ঋণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবণতা এবং আমানতের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায়। আমানতের এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিপ্রবণতা সাময়িক এবং অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করলে অচিরেই আমানতের প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে। অর্থনীতি যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলে আসতে পারে, তাহলে মানুষের আয় বাড়বে। তারা আবারও আগের মতো ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণ করতে পারবে।