আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে সরকার।২৪ জুলাই অর্থ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভাকে এক চিঠিতে এ ঋণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।সংকটে পড়া বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির উন্নতি,বৈদেশিক মুদ্রার মজুত চাঙ্গা করা এবং মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা আনতে সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে।বাজেট সহায়তা হিসেবে এই ঋণ নেওয়া হবে।অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়,এক বছর ধরে আইএমএফ থেকে এ ধরনের বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করে আসছে সরকার। এজন্য প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আইএমএফের বাংলাদেশ অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে আগে থেকে আলোচনা করা হয়েছে।সর্বশেষ আইএমএফের যে মিশন বাংলাদেশ সফর করেছে তাদের সঙ্গেও আলোচনা হয়।আইএমএফের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পরই সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক আবেদন করা হলো।এখন আইএমএফ এই ঋণের বিষয়ে তাদের একটি কমিটি করবে।ওই কমিটি বাংলাদেশ সফর করবে।সরকারের সংশ্নিষ্ট পক্ষের সঙ্গে ঋণের শর্তসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।সবকিছু মিলিয়ে এই ঋণ অনুমোদন হতে আরও চার বা পাঁচ মাস লেগে যাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে এসেছে।গত ২০ জুলাই রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার,যা দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।টাকার মান নেমেছে তলানিতে।ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলার জন্য প্রতি ডলার ৯৫ থেকে ৯৭ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।কমছে রেমিট্যান্স।গত জুন মাসে আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম রেমিট্যান্স এসেছে।বৈশ্বিক বাজারে পণ্য মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৭৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়েছে,যা আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।এতে বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপকভাবে বেড়ে ৩০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে।অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের তুলনায় কমেছে।সামগ্রিকভাবে লেনদেনের ভারসাম্যে ব্যাপক নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি ১৭ বিলিয়ন ডলার পার হয়ে গেছে।সামগ্রিকভাবে বৈদেশিক লেনদেন,বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এবং বিনিময় হার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।এ রকম অবস্থায় সরকার বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে নিরাপদ রিজার্ভ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন,আইএমএফ এই ঋণ দিতে বেশ কিছু শর্ত দিতে পারে সরকারকে।যার মধ্যে জ্বালানির ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে দেওয়া অন্যতম।এ ছাড়া জ্বালানি তেলের বাজারভিত্তিক দাম কার্যকর করা।ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদ হারে সীমা তুলে দেওয়া।ব্যাংক খাতে সুশাসন বাস্তবায়ন,বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হিসাব করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা এবং রাজস্ব সংগ্রহের ভিত্তি বাড়ানোর শর্ত দিতে পারে আইএমএফ।আগামী সেপ্টেম্বরে এ বিষয়ে আইএমএফের যে মিশন আসবে তারাই ঋণের শর্ত নিয়ে আলোচনা করবে।বাংলাদেশ সরকার শর্তে রাজি হলে এ ঋণ অনুমোদনের জন্য আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তোলা হবে।দেশের বিশেষজ্ঞরা অবশ্য আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে,তাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।তাঁরা বলছেন,এতে বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতা কমে আসার পাশাপাশি আর্থিক খাতে কিছু মৌলিক সংস্কার উদ্যোগও আসবে।আগামীতে বৈদেশিক মুদ্রার যে বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে সেখানে জোগান দেওয়া সহজ হবে।ফলে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার উপযুক্ত সময় এখন।
এর আগেও বাংলাদেশ বিভিন্ন সংকটকালীন সময়ে আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে।১৯৯০ সালে আইএমএফ থেকে প্রথম ঋণ নেয় বাংলাদেশ।তখন সামান্য পরিমাণে ঋণ নেওয়া হয়েছিল।এরপর ২০০৩ সালে দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধি সুবিধার (প্রভার্টি রিডাকশন অ্যান্ড গ্রোথ ফ্যাসিলিটি) আওতায় বাংলাদেশ ৩০ কোটি ডলার ঋণ নেয়।এরপর ২০১১ সালে টাকার মান দ্রুত অবনতি হলে সরকার এপটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির আওতায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যবহার করে।সর্বশেষ করোনার সময়ে র্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যান্ড পারচেজ অব র্যাপিড ফ্যাইনান্সিং ইনস্ট্রুমেন্ট আওতায় ৭৩ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের জুন শেষে বাংলাদেশের কাছে আইএমএফের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮৮ কোটি ৯৮ লাখ এসডিআর বা প্রায় ১২০ কোটি ডলার।
এ ছাড়া করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সরকার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাজেট ও টিকা সহায়তা হিসেবে ঋণ নিচ্ছে।২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত সরকার বিশ্বব্যাংক,এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক,জাইকা,ওপেক ফান্ড,কোরিয়ান ঋণদাতা সংস্থা ইডিসিএফ,ইইউ,জার্মানির সংস্থা কেএফডাব্লিউ,এএফডি থেকে ৭ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়েছে।এর মধ্যে ৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে বিভিন্ন সংস্থা।চলতি ২০২৩-২৩ অর্থবছরে বাকি ১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ছাড় হবে বলে আশা করছে সরকার।