আমরা জানি, রাজনীতির মাঠে অর্থের প্রয়োজন হয়। ক্ষমতাসীন, ক্ষমতার বাহিরে সকল দলেরই দল চালাইতে অর্থ লাগে। ইহা এক অনিবার্য বিষয়। এমনিতে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে উন্মুক্তভাবে রাজনৈতিক দলে অর্থ ডোনেট (দান) করিবার প্রচলন নাই, যাহা উন্নত বিশ্বে রহিয়াছে। দলের সদস্যদের নিকট হইতে চাঁদা তুলিবার ব্যবস্থা কোনো কোনো দলে থাকিলেও তাহা দ্বারা আসলে দল পরিচালনা করা সম্ভব নহে। কেননা কোনো দল চালাইতে হইলে এই উচ্ছিষ্ট দিয়া দল চলে না, তাহা কে না জানেন? এই জন্য তাহারা বিভিন্ন উৎসর উপর নির্ভর করিয়া থাকেন। উন্নয়নশীল দেশে সরকারি দলের বিরুদ্ধে প্রায়শ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়। তাহারা বিভিন্ন প্রকল্প হইতে পরোক্ষভাবে অর্থ আদায় করিতে পারেন। যাহারা ব্যবসায়-বাণিজ্য করেন, নানাভাবে সরকার তাহাদের ঘাড় মটকাইতে পারে। ক্ষমতায় যাহারা থাকেন, তাহাদের হাত যে কত লম্বা হয়, তাহা অনেকেরই অজানা নহে। এমনকি তাহাদের ভগবানের দশ হাতের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। চোখের ইশারায় অনেক কিছু ঘটিয়া যায়। কিন্তু ক্ষমতাসীন ছাড়া অন্য দলগুলিকে সহায়তা করেন কাহারা? বিশেষ করিয়া যাহারা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাহাদের কাহারা অর্থায়ন করিয়া থাকেন?
উন্নয়নশীল দেশে অনেক রাজনৈতিক দলের মেম্বারশিপ পর্যন্ত নাই। তাহা হইলে দল চালাইতে তাহারা টাকা পান কোথা হইতে? উন্নত বিশ্বে রাজনৈতিক দলগুলিকে ডোনেশনের কথা উল্লেখ করিতে হয়। কে কত টাকা দিলেন তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হয়। এখন যদি উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে কে কত টাকা দেন, তাহার হিসাব নেওয়া শুরু হয়, তাহা হইলে দেখা যাইবে, কেহ পাঁচ টাকাও আর দলকে চাঁদা দিবেন না। কেননা এই পাঁচ টাকাটা শেষ পর্যন্ত তাহাকে ইনকাম ট্যাক্সে দেখাইতে হইবে এবং তাহা না দেখাইতে পারিলে তাহাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হইলেও অবাক হইবার কিছু থাকিবে না। ক্ষমতাসীন দল যদি মনে করে, বিরোধী দল যাহারা করেন তাহাদের ধরিতে হইবে, তবে তাহারা এইভাবে অনায়াসেই ধরিতে পারেন। এমন অবস্থায় এই সকল ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থায়ন উত্সাহিত হইতে পারে। এমনিতেই এই সকল দেশের রাজনৈতিক দলগুলিতে বিদেশি অর্থায়নের অভিযোগ নূতন নহে। তাহা হইলে আমরা কি এখন দেশীয় অর্থায়নের পথ বন্ধ করিয়া বিদেশি অর্থায়নকেই উত্সাহিত করিবার পক্ষপাতী? উন্নয়নশীল দেশে আমরা কী করিতে গিয়া কী করিতেছি এবং ক্ষমতার পালাবদলে ইহার পরিণামই-বা কী হইতে পারে, তাহা কি আমাদের একবারও চিন্তা করিয়া দেখা উচিত নহে?
উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলিতে ব্যবসায়-বাণিজ্যের বেশির ভাগ সরকারের হাতেই থাকে। ফলে ব্যবসায়ীদের সরকারের গুণকীর্তন করিতেই হয়। তাহারা রাজনীতি করেন বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি না। তবে নিজেদের ব্যবসায়ের স্বার্থে তাহারা রাজনৈতিক দলের শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থক ইত্যাদি শব্দে বিশেষায়িত হন। যাহারা বিরোধীদের সঙ্গে থাকেন বা সহায়তা করেন, তাহাদের আশা থাকে যে, দল ক্ষমতায় গেলে তাহারা ব্যবসায়-বাণিজ্যে লাভ করিয়া সুদে-আসলে বিনিয়োগ উঠাইয়া নিতে পারিবেন। কিন্তু এখন যদি তাহাদের লইয়া ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়, তাহলে একসময় কি ইহার পালটা ব্যবস্থা নেওয়া হইবে না? উন্নয়নশীল বিশ্বের নাগরিকদের এই জন্য ভোগান্তির কোনো শেষ নাই। অতএব, নিজে সুখে থাকিতে অন্যের অবস্থান জানিতে হইবে, অনুধাবন করিতে হইবে। সেই সঙ্গে জনমতের দিকেও লক্ষ রাখিতে হইবে এবং জনমতকে সম্মান জানাইতে হইবে। উন্নয়নশীল দেশে সকলেরই মনে রাখা উচিত, ‘এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে, এই দিনেরে লইয়া যাইব সেই দিনেরই কাছে’।