ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের চলমান সংঘাত নবম দিনে গড়িয়েছে। অব্যাহত রয়েছে উভয়পক্ষের হামলা-পালটা হামলা। ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে হামাসের হামলার পর পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। চলমান সংঘর্ষে এই লেখা পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এবং ১ হাজার ৩০০ ইসরাইলি নিহত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম জনবসতিপূর্ণ গাজা পরিণত হয়েছে ভয়ানক মৃত্যুপুরীতে। বহু নারী, শিশু ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হয়েছে হাজার দশেক মানুষ। গাজার হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে আহত লোকজনের চাপ সামলাতে। অর্থাত্, বিশ্বের এই প্রান্তে কী অবস্থা চলছে, তা সহজেই অনুমেয়।
প্রশ্ন হলো, এই সংঘাত শেষ হবে কীভাবে? কল্পনাতীত অস্থিরতা চলবে আর কতদিন? আর কত মানুষ প্রাণ হারাবে বুলেট-বোমার আঘাতে? এমন সব জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাধা অতিক্রম করে টেকসই স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার কোনো পথ খোলা আছে কি-না, এমন প্রশ্নও সামনে আসছে। এবং এই ভয়ানক যুদ্ধে কোনো একটা পক্ষ বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হলে তা থেকে আগামী দিনে আরো বড় ধরনের সহিংস পরিস্থিতি বিস্তার লাভ করবে কি-না, সেই আশঙ্কা আসছে ঘুরেফিরে!
লক্ষণীয়, ইসরাইল জোর দিয়েছে সামরিক ও অন্যান্য নিরাপত্তা কার্যক্রম বাড়ানোর ওপর। সাঁজোয়া রণবহর নিয়ে গাজায় ঢুকে গোটা অঞ্চলকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়াই যেন ইসরাইলি সেনাদের একমাত্র লক্ষ্য। এসব তো চাক্ষুষ দৃশ্য; কিন্তু পর্দার আড়ালে ঠিক কী ঘটছে, তা কে বলতে পারে! ইসরাইল-হামাস সংঘাতের সূত্র ধরে এই অঞ্চলে দীর্ঘ মেয়াদে যা ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন তোলা যায়—জটিল সব হিসাবনিকাশের বাইরে গিয়ে কূটনীতিক ও রাজনৈতিক নেতাদের কি কিছুই করার নেই?
ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সত্যিকারের এজেন্ডা হওয়া উচিত যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার বিষয়ে কার্যকর উপায় খোঁজা। শান্তির স্বার্থে পরিচালিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে তা অনেক বেশি নিরাপদ করে তুলবে এই অঞ্চলসহ গোটা বিশ্বকে। খালি চোখে এই কাজকে ‘নাগালের বাইরে’ বলে মনে হতে পারে; কিন্তু পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ একেবারে অসম্ভব চিন্তা নয়। এক্ষেত্রে অনুসরণ করা যায় ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়নের চিন্তা। গুরিয়নের ভাষায়, ‘…বাস্তববাদী হতে হলে আপনাকে অবশ্যই অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতে হবে।’
ভয়ানক এই সংঘাতে আমরা ইতিমধ্যে বহু মানুষকে লাশে পরিণত হতে দেখেছি। বহু ইসরাইলি নিহত হয়েছেন। প্রাণ গেছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির। হামাসের হামলার পর ইসরাইলি সেনাবাহিনীর পালটা আক্রমণের মুখে আতঙ্কিত-দিকভ্রান্ত গাজার লাখ লাখ মানুষ আবারও ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহারের শিকার হচ্ছে! ইসরাইল-হামাস সহিংসতা যেন বারবার এটাই বলতে চায়— ‘এই অঞ্চলে শান্তি একেবারে অসম্ভব!’ এই যখন অবস্থা, তখন একই প্রশ্ন ফিরে আসে—রাজনীতিবিদ কিংবা সামরিক নেতাদের কি আসলেই কিছু করার নেই?
জানতে চাওয়া হতে পারে, এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে কোন পক্ষ? এর একমাত্র উত্তর হলো, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ফলাফল যাই হোক না কেন, এর রাজনৈতিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। মধ্যপ্রাচ্য থেকে হয়তো-বা কোনো কোনো পক্ষ দূরে সরে যেতে চাইবে, কিন্তু তাতে কি পুরোপুরি শান্ত হবে মধ্যপ্রাচ্যের মাটি? শুধু তাই নয়, হামাস-ইসরাইল এবারের সংঘাতের মধ্যে ‘ইরান প্রশ্ন’ বড় আকারে সামনে আসছে! এর ফলে কী হতে পারে? বছরের পর বছর ধরে হামাসকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে সমর্থন করার অভিযোগ যার কাঁধের ওপর, সেই ইস্যু নিয়ে যে কম জল ঘোলা করার ঘটনা ঘটবে না, তা বলাই বাহুল্য।
মাথায় রাখার বিষয়, এই অঞ্চলে ইরান হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এখানে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব রয়েছে ইরানের। চলমান সংঘাত সৃষ্টির পেছনে এখন পর্যন্ত তেহরানকে জড়িয়ে সরাসরি তেমন কোনো কথা বলা না হলেও কিংবা ইরানের সশস্ত্রগোষ্ঠী হেজবুল্লাহর সম্পৃক্ততার প্রমাণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও বিষয়টা কি এখানেই মিটমাট হয়ে যাবে?
জানা যাচ্ছে, ইরানকে হামাসের শীর্ষ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে হোয়াইট হাউজ। ঘটনা এখানেই থেমে নেই; ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই ধীরস্থির ও কঠোর সতর্কতার সঙ্গে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে। ঠিক এমন অবস্থায়, এই পক্ষ যদি ইরানি বন্দুকে সদ্য পোড়া বারুদের গন্ধ খুঁজে পায় ঘুণাক্ষরেও, তাহলে যে কী ঘটতে পারে তা আর বলে দিতে হবে না!
গণমাধ্যমের খবর, ইসরাইলে অপারেশন চালানোর জন্য হামাসের প্রশংসা করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। যদিও হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে তেহরান। এই পটভূমিতে মনে রাখতে হবে, এই যুদ্ধে যে পক্ষই বিজয় লাভ করুক না কেন, দিনশেষে তেহরানের বিশেষ লাভ হবেই কোনো না কোনোভাবে!
হামাসের লক্ষ্য ইসরাইলকে ধ্বংস করা। ইসরাইলের দখলতারিত্বের অবসান ঘটানো। ইসরাইলের লক্ষ্যও একই ধরনের—হামাসকে নির্মূল করা শেকড়সমেত। অর্থাত্, উভয় পক্ষের এই রেষারেষি সংশ্লিষ্ট অঞ্চল তো বটেই, ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার জন্ম দিচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেও। চরম ভয়, আতঙ্কে রয়েছে অঞ্চলগুলোর লাখ লাখ বাসিন্দা। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর নির্বিচার বিমান হামলা ও বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণে চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণভয়ে এরই মধ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে ৪ লাখের বেশি মানুষ।
জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা ওসিএইচএ এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজা উপত্যকায় মানুষ গণহারে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। গাজায় সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে। অচল হয়ে পড়েছে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। এতে বিভিন্ন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। নেমে এসেছে চরম মানবিক পরিস্থিতি।
আসল কথায় ফিরে আসা যাক। হামাসের অপারেশনের আসল উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন কিংবা এর পেছনে ইরান বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর হাত থাকুক-না থাকুক, এমন বিশ্বাস জন্মানো স্বাভাবিক যে, বিশেষ করে সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের সম্ভাবনা ভেস্তে দেওয়ার চিন্তা থেকেই এ হামলার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
ফিরে দেখার বিষয়, লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এখন আর তেমন একটা জনপ্রিয় নন! একইভাবে বেশ ঝামেলায় আছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও। সম্প্রতি বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থানের মুখে নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়েন তিনি। ঠিক এমন একটা অবস্থায় সংকট উত্তরণে তথা নিজ নিজ দেশের বিক্ষুব্ধ জনতার দাবি-দাওয়ার বিষয়কে পাশ কাটিয়ে কিছু করতে পারবেন না দুই শাসকের কেউই। জনগণকে পাত্তা না দিয়ে কিছু করতে গেলে গভীর বিভাজন উভয় দেশকে আরো দুর্বল করে তুলবে, যার ফলে এই দুই শাসক নিশ্চিতভাবে পড়বেন বড় বিপদে!
বাস্তবতা হলো, সংকট-হানাহানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেগ-অনুভূতি তীব্রতর হয়ে ওঠে। ভয়, দুঃখ বাড়ে জনগণের মধ্যে এবং তার সঙ্গে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় রাগ, ক্ষোভ, অভিমান। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে স্বভাবতই। অর্থাত্, হামাস বা ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরাইলের যে সংঘাত, তা কেবল নতুন নতুন চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দেবে বিশ্বের জন্য। সুতরাং, সংকটের বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার স্বার্থে বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে বিশ্বনেতৃত্বকে। আরো বিধ্বংসী অবস্থা এড়াতে চাইলে সংকট উত্তরণের যুতসই উপায়ের সন্ধান করতে হবে। এবং তাও করতে হবে কূটনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক হিসাবনিকাশের বাইরে গিয়ে। বিষয়টা অলৌকিক বলে মনে হবে হয়তো-বা (যেমনটা বলেছেন ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন); কিন্তু এই দুঃস্বপ্নের যাত্রা থামাতে বিকল্প কোনো রাস্তা খোলা নেই!