বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিসহ ২২ তারিখে সংঘটিত ছাত্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর তীব্র প্রতিক্রিয়া ও গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়। ‘এলিস কমিশন’ নামে গঠিত এই কমিশনের পেশকৃত প্রতিবেদন ছিল পাকিস্তানি শাসক চক্রকে দায়মুক্ত ও নির্দোষ প্রমাণ করার অপপ্রয়াস মাত্র। এই পক্ষপাতদুষ্ট, প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিবেদন তখনকার রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসমাজ প্রত্যাখ্যান করে এবং এ নিয়ে সমসাময়িককালের পত্রিকাগুলোতে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।
বিচার বিভাগীয় তদন্তের নামে একজন অবাঙালি ও বিদেশি বিচারক টি হোবার্ট এলিসন যে ফরমায়েশি ও একপেশে মিথ্যায় ভরপুর প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন, তাতে তিনি বিচারক হিসেবে এক দিকে যেমন শপথ ভঙ্গ করেছেন, অন্যদিকে নৈতিক মানদণ্ডে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, কলঙ্কিত করেছেন নিজেকে, যার জন্য ইতিহাস তাকে কখনো ক্ষমা করবে না, আজীবন ধিক্কার পেয়ে যাবেন।
পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় পুলিশের গুলি করা প্রয়োজন ছিল কি না, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শক্তি প্রয়োগ যথার্থ ছিল কি না, যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি মহোদয় ঢাকায় কর্মরত বিদেশি বিচারপতি টি এইচ এলিসনকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেন। কমিশন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য আহ্বান করেন। একই সঙ্গে পূর্ব বাংলার সরকারপক্ষ এবং মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সশরীরে উপস্থিত বক্তব্য নিলেও অবাক করা বিষয় হলো, ছাত্রদের যথাযথ বক্তব্য প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। উলটো বাঙালি ছাত্র-জনতা, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিকে মিথ্যাভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের কথা বলে এলিস সাহেব গুলি করার ঘটনাকে অনিবার্য, বৈধ করলেও সেদিন বাংলার ছাত্রসমাজ সারিবদ্ধভাবে পরিষদের দিকে মিছিলসহকারে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিল। নিরস্ত্র ছাত্রদের হাতে ছিল না কোনো লাঠি, বাঁশ কিংবা অস্ত্র। অথচ বলা হলো শৃঙ্খলা রক্ষার্থে, জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ কেবল হোস্টেলের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গুলি করতে বাধ্য হয়েছিল। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে কীভাবে ২০ নম্বর শেডসহ ছাত্রাবাসে অবস্থানরত ছাত্রদের পেটে, মাথায় গুলি লাগল, পথচারী শহিদ হলো? ছাত্র ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে গুলি করলে কি মাথার খুলি উড়ে যাওয়ার কথা? একজন শপথধারী বিদেশি বিচারক হয়ে তিনি গোপনে এই তদন্ত সম্পন্ন করেন এবং প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, সেদিন মিছিলে পুলিশের গুলি করা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল এবং পরিস্থিতির বিবেচনায় পুলিশের শক্তি প্রয়োগের যথার্থ কারণ ছিল। লেখা হলো, মিছিলকারী ছাত্ররা ছিল উচ্ছৃঙ্খল ও দাঙ্গাবাজ। তাদের ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে কেবল ২৭ রাউন্ড গুলি করা হয়েছিল।
তৎসময়ের অনেক রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের মতে, পাকিস্তান সরকারের কিছু অতিরিক্ত সুবিধা ও হালুয়ারুটির আশায় শাসক সেবক হিসেবে এমন ফরমায়েশি প্রতিবেদন তিনি জমা দিয়েছেন।
একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় এলিসন সাহেব এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলার অবাঙালি অফিসার ও শাসকগণকে দায়ী করা যায়, কেবল তা নয়, পুলিশের বাঙালি এসপি মো. ইদরিস, ডিআইজি ওবায়দুল্লাহ ও সব শেষে নূরুল আমিন কি ছাত্র হত্যার ঘটনায় দায় এড়াতে পেরেছেন? তারা ভাষায়, পোশাকে, জন্মসূত্রে বাঙালি হয়েও নিজ মাতৃভাষা, নিজ জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছেন। সে জন্য ইতিহাস তাদের কখনো ক্ষমা করেনি, করবেও না।
আমাদের ভাই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, অহিউল্লাহর রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো। বাংলা মায়ের বুক খালি করল। একটি স্মৃতির মিনার নির্মাণে পর্যন্ত শাসক চক্রের পেটোয়া বাহিনী বাধা দিয়েছে। তার পরও ’৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয় শাসক চক্র। এলিস কমিশনের মিথ্যা প্রতিবেদনের বিপরীতে বাঙালির প্রাপ্তির ঝুড়ি আরো বাড়ল।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ৩১ মে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত ১৮ মিনিটের ঘটনার মিথ্যায় ভরপুর একপেশে প্রতিবেদন প্রকাশ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার গণদাবি রোধ করার চেষ্টা করলেও প্রতিবাদের আগুন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি তার ভাষার দাবি আদায়ে সফল হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, ইংরেজিতে লেখা ঐ প্রতিবেদন আমরা কখনো লোকসম্মুখে আনিনি, বাংলায় অনুবাদ করার প্রয়াসও নেওয়া হয়নি। এটা আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন কিংবা আইনবিষয়ক জটিলতা থাকতে পারে এমন শঙ্কায় আমরা আলোয় আনতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সহায়তায় তরুণ গবেষক, লেখক রাশেদ রাহম প্রতিবেদনটি বাংলায় অনুবাদ করে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ছাত্র হত্যাকাণ্ড, এলিস কমিশন রিপোর্ট’ শীর্ষক বই আকারে প্রকাশ করে।
অনুবাদসহ ইংরেজি প্রতিবেদন এবং তার পালটা সত্য ঘটনা সংবলিত বই, তথ্যচিত্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রেখে যাওয়াই আমাদের এই সময়ের কর্তব্য।