২০১৪ ইং সাল থেকেই শুরু করি। প্রোগ্রামিং এ খুব একটা খারাপ ছিলাম না। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (দুই মেয়াদঃ ২০০৬-২০১০, ২০১৩-২০১৫) ছাত্র থাকাকালীন (১ম মেয়াদঃ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রায় সময়ই C ও C++ Programming এবং পরবর্তিতে C# Programming নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম। তাই নিজের মাঝে এই স্বপ্ন নিয়েই চাকুরীর বাজারে ঢুকে যাই যে আমি সফটওয়্যার ডেভেলপার হবো। মাশা আল্লাহ্, নাম্বার ১ নাহলেও খুব একটা খারাপ কোম্পানিতে চাকুরি করতাম না। সে সময় ব্র্যাক ব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান (বিটস) এ চাকুরি করতাম (২০১৪-২০১৫)। বেতন খুব বেশি না হলেও, কাজের পরিবেশটা ছিল অনেক ভাল। আর পাশাপাশি Daffodil International University এর Software Engineering ডিপার্টমেন্টে খন্ডকালীন শিক্ষক (২০১৪-২০১৬) হিসেবে ২টা কোর্স পড়াতাম। একটা ব্যাচেলর এবং আরেকটা ছিল মাস্টার্সের কোর্স। সেমিস্টার শেষে বেশ একটা ভালো পরিমানের সম্মানী পেতাম, তাই ভালই চলছিল দিন-কাল, অফিস, বাসা, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। বলে রাখা ভাল, একটা সুনামের সাথেই Daffodil-এ খন্ডকালীন চাকুরীটা চলছিল এবং ছাত্রদের কাছে, বিভাগের কাছে অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম যেটা আমাকে অনেক আনন্দ এবং অনুপ্রেরণা দিতো শিক্ষাকতা পেশায়। ফলস্বরূপ, প্রতি সেমিস্টারেই বিভাগের সম্মানীয় চেয়ার বলতেন, “রানা স্যার, আপনি যখনি ইচ্ছা পোষণ করবেন পূর্নকালীন চাকুরীর জন্য, আমি তখনই ব্যবস্থা করবো।” ভদ্রলোক ছিলেন এককথায় অসাধারন মানুষ এবং একজন সঠিক পথ প্রদর্শক। আমার জীবনের চাকা ঘুরানোর প্রথম কাজ মহান আল্লাহপাক তাকে দিয়েই করিয়েছিলেন।
ভাগ্যগুনে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশেরই একটা স্বনামধন্য সফটওয়্যার ফার্ম হতে দ্বিগুণ বেতনের চাকুরীর অফার পাই। সুযোগটা হাতছাড়া না করে লুফে নিলাম। কিন্তু, বিধিবাম! চাকুরীটা বেশিদিন করতে পারি নাই। কারণ আমার রিপোর্টিং বস (টিম লিডার)-টা সুবিধাজনক ছিল না। সমবয়সী অর্থাৎ একই ব্যাচের হওয়ায়, ভদ্রলোকের মতের সাথে আমার মতের মিল খুব কমই হতো। ভদ্রলোকটা এতটাই ভালোছিলেন যে তার অধিনে এখন পর্যন্ত কেউ চাকুরী চলমান রাখতে পারে নাই। কেউ হয়তো স্বেচ্ছায় চলে গেছেন আবার কাউকে হয়তো তাড়ানো হয়েছিল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমাকেও চাকুরী ছাড়তে হয়েছিল বাধ্য হয়েই। হটাৎ বেশি বেতনের চাকুরী হারিয়ে প্রায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, তারপর আবার বউ সন্তান-সম্ভবা, কয়েকদিন পর বাচ্চা হবে, আমার মাও ছিলেন অসুস্থ, প্রতি মাসে তার জন্য অনেক টাকার ঔষধ লাগতো। অনেক জায়গায় ভাইবা দিচ্ছি, কোথাও থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছি না, যাও বা পাচ্ছি ব্যাটে-বলে মিলছে না। তখনই মাথায় আসলো, Daffodil এর কথা। যাইহোক, কপাল ভালো ছিল, তাই পূর্ণমেয়াদী চাকুরীটা পেলাম। কিন্তু বেতন অনেক কম ছিল, তাই অতিরিক্ত কোর্স নিয়ে সেমিস্টার শেষে কিছু বাড়তি টাকা পেতাম, তা দিয়েই কোনভাবে চলতে লাগলো টুনাটুনির সংসার, তবে দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের বাচ্চাটা জন্মের ৩দিন পরই মারা গেলো। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম যা আগে কখনও পাই নাই।
এবার আসি আসল গল্পে, ২০১৬ এর শেষের দিকে আমার মাস্টার্সের রিসার্স থেকে করা একটা আর্টিক্যাল একসেপ্ট হয় একটা কনফারেন্সে যেটা আমাকে প্রেজেন্ট করতে হবে সেখানে গিয়ে। কনফারেন্সটা ছিল নেপালে ২০১৭ সালের মার্চ মাসের ২-৪ তারিখে। যেহেতু আমি কমিউনিকেশন (পাবলিক স্পিকিং)-এ দুর্বল, তাই আমি আমার কো-অথর (সহকর্মী)-কে অনুরোধ করলাম প্রেজেন্ট করে আসতে। আরেকটা কারণ ছিল, তা হল আমার পাসপোর্ট ছিল না। যাইহোক, কথা পাক্কা, তিনিই যাবেন। কিন্ত, ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে, কোন এক অজানা কারনে তিনি যেতে পারবেন না বললেন। কি আর করা, আমাকেই যেতে হবে, আমি তো ছিলাম সেই ভয়ে, কারণ আমি কথা বলতে পারিনা সেভাবে। তারপর আবার আন্তর্জাতিক কনফারেন্স বলে কথা। বিভাগের চেয়ার আমাকে সাহস দিয়ে বললেন আপনি গিয়ে ডায়াচে দাড়িয়ে প্রেজেন্টেশন চালিয়ে স্লাইড দেখে দেখে বলবেন, কোন সমস্যা নাই। পাশাপাশি আরেকটা চ্যালেঞ্জ ছিল ১০ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট করতে হবে। ভাগ্যগুনে সেটাও হয়েছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার ব্যাচের আইসিটি বিভাগের এক কাছের বন্ধু মাহমুদ এর মাধ্যমে। ও নিজ দায়িত্বে বা ক্ষমতায় ১০ দিনের মধ্যে বন্ধু আমার পাসপোর্ট টা করিয়ে দিয়েছিল। “দোস্ত, তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ রে”।
মার্চের ২ তারিখ, জীবনে প্রথম উড়োজাহাজে চড়লাম, ভাবই আলাদা। ল্যান্ড করার পর থেকে হোটেল পর্যন্ত যেতে খুব একটা সমস্যা হয় নাই। কারন যাত্রাপথে যাদের সাথে আমার কথপোকথন হয়েছিল এযাবৎ তারা সবাই ছিল প্রায় আমার মতই ইংরেজিতে রয়েল বেঙ্গল ক্যাট। ভাবলাম আসলাম যেহেতু, দেখি না চেস্টা করে কিভাবে ভাল প্রেজেন্টেশন দেয়া যায়। ৪০-৫০ টার মত স্লাইড বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতে ইন্টারনেট ঘেটে ধারনা নিলাম কি ভাবে ভাল প্রেজেন্টেশন দিতে হয়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আনুযায়ী, ছাটতে ছাটতে স্লাইডের সংখ্যা গিয়ে দাড়ালো মাত্র ১১-১২ তে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে গিয়ে কনফারেন্সে পৌছাতে একটু দেড়ি হয়ে গেল। গিয়ে দেখি কনফারেন্স রুম ছিল প্রায় প্রেজেন্টার আর অডিয়েন্সে ভর্তি। কোনমতে, একটা আসন ফাকা পেলাম এক আমেরিকান প্রফেসরের পাশে। তিনি বললেন এত দেড়ি কেন? কনফারেন্স মানে শুধু নিজের প্রেজেন্টেশন না, অন্যরা কি রিসার্স করছে সেটা জানাটাও জরুরী, আর এটাই হল কনফারেন্সের উদ্দেশ্য। সে যাইহোক, অনেক বাঘা বাঘা প্রেজেন্টারের ভিড়ে আমিও প্রেজেন্টেশন দেয়া শুরু করলাম। জানি না সেদিন আমার উপর কি (কোন জ্বীন-টিন হতে পারে, ভিন্ন ধর্মমতে দেবতা/অসূর ও হতে পারে) ভর করেছিল। এত সুন্দর প্রেজেন্টেশন কখনও দিয়েছি বলে মনেহয় না। ফলাফল, সেশন শেষে, মধ্যহ্ন ভোজনের আগে আমার নাম ঘোষণা করা হল যে আমি নাকি “বেষ্ট প্রেজেন্টার”। রাতের খাবারের সময় অপেক্ষা করছিল বড় চমক। সেটা কি? বেস্ট পেপার এওয়ার্ড, সেটাও আমাকে দেয়া হল। ফলাফল হিসেবে, ২জন প্রফেসর, একজন আমেরিকান, ভাগ্যগুনে যার পাশের সিটে আমি বসেছিলাম (তিনিই আমার একাডেমিক (পিএইচডি) এডভাইজার, মেন্টর, ইত্যাদি এবং যার বদৌলতে আজ আমার এই বর্তমান অবস্থান), আর একজন ছিলেন ব্রিটিশ (ইংল্যান্ড) যিনি আমার সেশনের চেয়ার ছিলেন)। সরাসরি পিএইচডি এর অফার দিয়ে বসলেন দুই ভদ্রলোক। এ যেন প্রেমের অফার, সিদ্ধান্ত নিতে হিমসিম খাচ্ছিলাম কোনটা ছেড়ে কোনটা গ্রহন করবো, আমি তখন মাটিতে ছিলাম নাকি আকাশে উড়তে ছিলাম এখন সঠিক মনে নাই, তবে অনেক ভাব যে নিয়েছিলাম এটা ধ্রুব সত্য। যাইহোক, সবশেষে আমেরিকাতেই যাব, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললাম। আমার মত একজন নাদান মানুষ যে একটা আমেরিকান ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেতে পারে, এটা বিশ্বাস করতে বা মানতে অনেকের অনেক কষ্ট হয়েছে। অনেককে তো আমার আমেরিকান স্কলাশিপের কথা শুনে এও বলতে শুনেছি যে “আমেরিকা যাইতেছো ভালকথা, দেখো আবার, ফিরতি প্লেনে যেন দেশে পাঠিয়ে না দেয় তোমাকে!” আমি সেটাতে কিছুই মনেকরি নাই। কারণ, পিছু লোকে অনেক কিছু বলবেই, সেটাই তাদের স্বভাব। আমাকে সেটা ভাবলে হবে না, আমার গন্তব্যে আমাকেই পৌছাতে হবে।
দেশে থাকাকালীন একটা ঘটনা মনেপরে গেলো। একবার কুয়েটে (Khulna University of Engineering and Technology) এ লেকচারার পদের চাকুরীর অংশ হিসেবে একটা মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। আমার কোন এক নামধারী বন্ধু বলেছিল, “তুমি পাবলিক এ চেস্টা করার চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চেস্টা করো, সেটাই ভাল।” বিষয়টা এমন যে, তুই কোথাকার কে হে! যে তোর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী হবে, এটাতো শুধুই তাদের (মেধাবী নামধারী) পৈতৃক সম্পত্তি।
যাইহোক, আমেরিকা আসলাম, শুরু হল আমার পিএইচডি অভিযান, অনেক চড়াই-উত্রাই ছিল এই অভিযানে (সেই গল্প না হয় অন্য একদিন হবে) যার স্বাক্ষী ছিলেন আমার গিন্নী, তার অনেক ত্যাগের জন্যই হয়তো আজকের এই আমি, তবে সবার আগে ধন্যবাদ দিতে চাই মহান সৃষ্টিকর্তাকে যিনি আমাকে-আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর আমার বাব-মা যারা আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। অবশেষে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, আমি সফলতার সাথে আমার পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করতে সক্ষম হই। শুরু হল চাকুরির সন্ধান। আমার তো প্রথম থেকেই ইচ্ছা ছিল আমি একাডেমিয়াতেই থাকবো। আমার এডভাইজারের ইচ্ছা ছিল যেন আমি ইন্ড্রাস্ট্রিতে যাই। উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন “তুমি টেকনোলজিতে অনেক ভাল, তোমার প্রোফাইল অনেক স্ট্রং ইন্ডাস্ট্রির জন্য, তোমার ইন্ড্রাস্ট্রিতে যাওয়া উচিৎ”। তিনি এও বলতেন, “তোমাকে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই শুধুমাত্র তোমার কমিউনিকেশন্স টা একটু ভাল করতে হবে।” যদিও একদিনে সেটা হয় নাই, এর পিছনে অনেক গল্প আছে, এই দুর্বলতার জন্য আমাকে একবার ঝামেলাতেও পরতে হয়েছিল। আমি একজন অতি সাধারন মানুষ। মন যা চায় সেটাই করি, কে কিভাবে নেবে সেটার বিচার করি না। আমি যেটা করতে সাচ্ছন্দ বোধকরি সেটাই করি। আর সেই কারনেই, Arizona State University (ASU) (যদিও তাদের অনুরোধে ২ সেমিস্টার ক্লাশ নিতে হয়েছিল অনলাইনে) এর চাকুরী ছেড়ে Northern Kentucky University (NKU) এর মত ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলাম, তারপর আমি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি University of Alabama at Birmingham (UAB)। বর্তমানে কর্মরত আছি ফ্লোরিডার Florida Gulf Coast University (FGCU) তে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। আমি আমার নিজের বিশ্বাসে সর্বদা অটল থাকার চেস্টা করি, নিজেকে অনেক বেশি সম্মান করি, ভালবাসি, পাশাপাশি ভালবাসি মানুষকে, কারণ সৃষ্টিকে ভাল না বাসলে স্রষ্টার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। আর একটা জিনিসে সর্বদা চেস্টা করি, সেটা হল ধৈর্য ধারণ করা। এর ফলাফল সবসময়ই ভাল হয়। এত কিছু বলার কারন হল, সর্বদা নিজেকে জানতে হবে আমি কি চাই বা আমি কি করতে পারি। কে কি করছে বা কি করতে পারে তার পানে না তাকিয়ে নিজ কাজে মনোনিবেশ করাই শ্রেয়। সবাই বিসিএস দিচ্ছে তাই আমাকেও দিতে হবে বা সবাই সরকারী চাকুরীর পিছনে ছুটছে তাই আমাকেও তাদের সাথে দৌড়াতে হবে আমার কাছে এর কোনই অর্থ নাই। লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই। আর আমেরিকা জ্ঞানের কদর করতে জানে খুব ভালভাবেই, তাই তারা আজ এখানে অবস্থান করছে। পা-চাটা, চামচামি, তৈল মর্দন এর কোন স্থান নেই এখানে। একটা কথা আছে, “Survival of the fittest”, এরা এটা পুরপুরি ভাবেই ব্যবহার করে এখানে।
ভাল থাকবেন সবাই, আর আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। একটা মেয়ে আছে আমার আলহামদুলিল্লাহ, সে খুবই দুষ্টু এবং মিস্টি। এখন একটু রাত জাগা কমিয়েছে সে! মনেপরে সেই কেনটাকিতে থাকাকালীন রাতগুলোর কথা। রাত ২-৩ টার সময় বলতেন, “বাবা চল ড্যান্স করি” আর তাই ইচ্ছা না থাকলেও বেসুরো গলায় গাইতে হতো কাঁচা বাদাম গান আর সাথে ড্যান্স” দিতে হয়। দিন শেষে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি মুসলিম বাবা-মায়ের মুসলিম সন্তান এবং আমি একজন বাবা, একজন স্বামী। বিদেশে উচ্চ শিক্ষা বা রিসার্স বিষয়ক যদি কিছু জানতে চান, দ্বিধা না করে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন আমার সাথে। মাধ্যমগুলো নিচে দেয়া আছে।
আল্লাহ্ হাফেজ।
Md Shohel Rana, Ph.D.
Assistant Professor । Computing and Software Engineering
Member of IEEE, IEEE Society & ACM
Florida Gulf Coast University (FGCU)
10501 FGCU Boulevard South, Fort Myers, FL 33965
P: 239.745.4513 | E: mrana@fgcu.edu | W: www.msrana.info
২০১৪ ইং সাল থেকেই শুরু করি। প্রোগ্রামিং এ খুব একটা খারাপ ছিলাম না। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (দুই মেয়াদঃ ২০০৬-২০১০, ২০১৩-২০১৫) ছাত্র থাকাকালীন (১ম মেয়াদঃ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রায় সময়ই C ও C++ Programming এবং পরবর্তিতে C# Programming নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম। তাই নিজের মাঝে এই স্বপ্ন নিয়েই চাকুরীর বাজারে ঢুকে যাই যে আমি সফটওয়্যার ডেভেলপার হবো। মাশা আল্লাহ্, নাম্বার ১ নাহলেও খুব একটা খারাপ কোম্পানিতে চাকুরি করতাম না। সে সময় ব্র্যাক ব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান (বিটস) এ চাকুরি করতাম (২০১৪-২০১৫)। বেতন খুব বেশি না হলেও, কাজের পরিবেশটা ছিল অনেক ভাল। আর পাশাপাশি Daffodil International University এর Software Engineering ডিপার্টমেন্টে খন্ডকালীন শিক্ষক (২০১৪-২০১৬) হিসেবে ২টা কোর্স পড়াতাম। একটা ব্যাচেলর এবং আরেকটা ছিল মাস্টার্সের কোর্স। সেমিস্টার শেষে বেশ একটা ভালো পরিমানের সম্মানী পেতাম, তাই ভালই চলছিল দিন-কাল, অফিস, বাসা, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। বলে রাখা ভাল, একটা সুনামের সাথেই Daffodil-এ খন্ডকালীন চাকুরীটা চলছিল এবং ছাত্রদের কাছে, বিভাগের কাছে অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম যেটা আমাকে অনেক আনন্দ এবং অনুপ্রেরণা দিতো শিক্ষাকতা পেশায়। ফলস্বরূপ, প্রতি সেমিস্টারেই বিভাগের সম্মানীয় চেয়ার বলতেন, “রানা স্যার, আপনি যখনি ইচ্ছা পোষণ করবেন পূর্নকালীন চাকুরীর জন্য, আমি তখনই ব্যবস্থা করবো।” ভদ্রলোক ছিলেন এককথায় অসাধারন মানুষ এবং একজন সঠিক পথ প্রদর্শক। আমার জীবনের চাকা ঘুরানোর প্রথম কাজ মহান আল্লাহপাক তাকে দিয়েই করিয়েছিলেন।
ভাগ্যগুনে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশেরই একটা স্বনামধন্য সফটওয়্যার ফার্ম হতে দ্বিগুণ বেতনের চাকুরীর অফার পাই। সুযোগটা হাতছাড়া না করে লুফে নিলাম। কিন্তু, বিধিবাম! চাকুরীটা বেশিদিন করতে পারি নাই। কারণ আমার রিপোর্টিং বস (টিম লিডার)-টা সুবিধাজনক ছিল না। সমবয়সী অর্থাৎ একই ব্যাচের হওয়ায়, ভদ্রলোকের মতের সাথে আমার মতের মিল খুব কমই হতো। ভদ্রলোকটা এতটাই ভালোছিলেন যে তার অধিনে এখন পর্যন্ত কেউ চাকুরী চলমান রাখতে পারে নাই। কেউ হয়তো স্বেচ্ছায় চলে গেছেন আবার কাউকে হয়তো তাড়ানো হয়েছিল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমাকেও চাকুরী ছাড়তে হয়েছিল বাধ্য হয়েই। হটাৎ বেশি বেতনের চাকুরী হারিয়ে প্রায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, তারপর আবার বউ সন্তান-সম্ভবা, কয়েকদিন পর বাচ্চা হবে, আমার মাও ছিলেন অসুস্থ, প্রতি মাসে তার জন্য অনেক টাকার ঔষধ লাগতো। অনেক জায়গায় ভাইবা দিচ্ছি, কোথাও থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছি না, যাও বা পাচ্ছি ব্যাটে-বলে মিলছে না। তখনই মাথায় আসলো, Daffodil এর কথা। যাইহোক, কপাল ভালো ছিল, তাই পূর্ণমেয়াদী চাকুরীটা পেলাম। কিন্তু বেতন অনেক কম ছিল, তাই অতিরিক্ত কোর্স নিয়ে সেমিস্টার শেষে কিছু বাড়তি টাকা পেতাম, তা দিয়েই কোনভাবে চলতে লাগলো টুনাটুনির সংসার, তবে দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের বাচ্চাটা জন্মের ৩দিন পরই মারা গেলো। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম যা আগে কখনও পাই নাই।
এবার আসি আসল গল্পে, ২০১৬ এর শেষের দিকে আমার মাস্টার্সের রিসার্স থেকে করা একটা আর্টিক্যাল একসেপ্ট হয় একটা কনফারেন্সে যেটা আমাকে প্রেজেন্ট করতে হবে সেখানে গিয়ে। কনফারেন্সটা ছিল নেপালে ২০১৭ সালের মার্চ মাসের ২-৪ তারিখে। যেহেতু আমি কমিউনিকেশন (পাবলিক স্পিকিং)-এ দুর্বল, তাই আমি আমার কো-অথর (সহকর্মী)-কে অনুরোধ করলাম প্রেজেন্ট করে আসতে। আরেকটা কারণ ছিল, তা হল আমার পাসপোর্ট ছিল না। যাইহোক, কথা পাক্কা, তিনিই যাবেন। কিন্ত, ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে, কোন এক অজানা কারনে তিনি যেতে পারবেন না বললেন। কি আর করা, আমাকেই যেতে হবে, আমি তো ছিলাম সেই ভয়ে, কারণ আমি কথা বলতে পারিনা সেভাবে। তারপর আবার আন্তর্জাতিক কনফারেন্স বলে কথা। বিভাগের চেয়ার আমাকে সাহস দিয়ে বললেন আপনি গিয়ে ডায়াচে দাড়িয়ে প্রেজেন্টেশন চালিয়ে স্লাইড দেখে দেখে বলবেন, কোন সমস্যা নাই। পাশাপাশি আরেকটা চ্যালেঞ্জ ছিল ১০ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট করতে হবে। ভাগ্যগুনে সেটাও হয়েছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার ব্যাচের আইসিটি বিভাগের এক কাছের বন্ধু মাহমুদ এর মাধ্যমে। ও নিজ দায়িত্বে বা ক্ষমতায় ১০ দিনের মধ্যে বন্ধু আমার পাসপোর্ট টা করিয়ে দিয়েছিল। “দোস্ত, তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ রে”।
মার্চের ২ তারিখ, জীবনে প্রথম উড়োজাহাজে চড়লাম, ভাবই আলাদা। ল্যান্ড করার পর থেকে হোটেল পর্যন্ত যেতে খুব একটা সমস্যা হয় নাই। কারন যাত্রাপথে যাদের সাথে আমার কথপোকথন হয়েছিল এযাবৎ তারা সবাই ছিল প্রায় আমার মতই ইংরেজিতে রয়েল বেঙ্গল ক্যাট। ভাবলাম আসলাম যেহেতু, দেখি না চেস্টা করে কিভাবে ভাল প্রেজেন্টেশন দেয়া যায়। ৪০-৫০ টার মত স্লাইড বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতে ইন্টারনেট ঘেটে ধারনা নিলাম কি ভাবে ভাল প্রেজেন্টেশন দিতে হয়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আনুযায়ী, ছাটতে ছাটতে স্লাইডের সংখ্যা গিয়ে দাড়ালো মাত্র ১১-১২ তে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে গিয়ে কনফারেন্সে পৌছাতে একটু দেড়ি হয়ে গেল। গিয়ে দেখি কনফারেন্স রুম ছিল প্রায় প্রেজেন্টার আর অডিয়েন্সে ভর্তি। কোনমতে, একটা আসন ফাকা পেলাম এক আমেরিকান প্রফেসরের পাশে। তিনি বললেন এত দেড়ি কেন? কনফারেন্স মানে শুধু নিজের প্রেজেন্টেশন না, অন্যরা কি রিসার্স করছে সেটা জানাটাও জরুরী, আর এটাই হল কনফারেন্সের উদ্দেশ্য। সে যাইহোক, অনেক বাঘা বাঘা প্রেজেন্টারের ভিড়ে আমিও প্রেজেন্টেশন দেয়া শুরু করলাম। জানি না সেদিন আমার উপর কি (কোন জ্বীন-টিন হতে পারে, ভিন্ন ধর্মমতে দেবতা/অসূর ও হতে পারে) ভর করেছিল। এত সুন্দর প্রেজেন্টেশন কখনও দিয়েছি বলে মনেহয় না। ফলাফল, সেশন শেষে, মধ্যহ্ন ভোজনের আগে আমার নাম ঘোষণা করা হল যে আমি নাকি “বেষ্ট প্রেজেন্টার”। রাতের খাবারের সময় অপেক্ষা করছিল বড় চমক। সেটা কি? বেস্ট পেপার এওয়ার্ড, সেটাও আমাকে দেয়া হল। ফলাফল হিসেবে, ২জন প্রফেসর, একজন আমেরিকান, ভাগ্যগুনে যার পাশের সিটে আমি বসেছিলাম (তিনিই আমার একাডেমিক (পিএইচডি) এডভাইজার, মেন্টর, ইত্যাদি এবং যার বদৌলতে আজ আমার এই বর্তমান অবস্থান), আর একজন ছিলেন ব্রিটিশ (ইংল্যান্ড) যিনি আমার সেশনের চেয়ার ছিলেন)। সরাসরি পিএইচডি এর অফার দিয়ে বসলেন দুই ভদ্রলোক। এ যেন প্রেমের অফার, সিদ্ধান্ত নিতে হিমসিম খাচ্ছিলাম কোনটা ছেড়ে কোনটা গ্রহন করবো, আমি তখন মাটিতে ছিলাম নাকি আকাশে উড়তে ছিলাম এখন সঠিক মনে নাই, তবে অনেক ভাব যে নিয়েছিলাম এটা ধ্রুব সত্য। যাইহোক, সবশেষে আমেরিকাতেই যাব, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললাম। আমার মত একজন নাদান মানুষ যে একটা আমেরিকান ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেতে পারে, এটা বিশ্বাস করতে বা মানতে অনেকের অনেক কষ্ট হয়েছে। অনেককে তো আমার আমেরিকান স্কলাশিপের কথা শুনে এও বলতে শুনেছি যে “আমেরিকা যাইতেছো ভালকথা, দেখো আবার, ফিরতি প্লেনে যেন দেশে পাঠিয়ে না দেয় তোমাকে!” আমি সেটাতে কিছুই মনেকরি নাই। কারণ, পিছু লোকে অনেক কিছু বলবেই, সেটাই তাদের স্বভাব। আমাকে সেটা ভাবলে হবে না, আমার গন্তব্যে আমাকেই পৌছাতে হবে।
দেশে থাকাকালীন একটা ঘটনা মনেপরে গেলো। একবার কুয়েটে (Khulna University of Engineering and Technology) এ লেকচারার পদের চাকুরীর অংশ হিসেবে একটা মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। আমার কোন এক নামধারী বন্ধু বলেছিল, “তুমি পাবলিক এ চেস্টা করার চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চেস্টা করো, সেটাই ভাল।” বিষয়টা এমন যে, তুই কোথাকার কে হে! যে তোর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী হবে, এটাতো শুধুই তাদের (মেধাবী নামধারী) পৈতৃক সম্পত্তি।
যাইহোক, আমেরিকা আসলাম, শুরু হল আমার পিএইচডি অভিযান, অনেক চড়াই-উত্রাই ছিল এই অভিযানে (সেই গল্প না হয় অন্য একদিন হবে) যার স্বাক্ষী ছিলেন আমার গিন্নী, তার অনেক ত্যাগের জন্যই হয়তো আজকের এই আমি, তবে সবার আগে ধন্যবাদ দিতে চাই মহান সৃষ্টিকর্তাকে যিনি আমাকে-আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর আমার বাব-মা যারা আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। অবশেষে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, আমি সফলতার সাথে আমার পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করতে সক্ষম হই। শুরু হল চাকুরির সন্ধান। আমার তো প্রথম থেকেই ইচ্ছা ছিল আমি একাডেমিয়াতেই থাকবো। আমার এডভাইজারের ইচ্ছা ছিল যেন আমি ইন্ড্রাস্ট্রিতে যাই। উনি আমাকে প্রায়ই বলতেন “তুমি টেকনোলজিতে অনেক ভাল, তোমার প্রোফাইল অনেক স্ট্রং ইন্ডাস্ট্রির জন্য, তোমার ইন্ড্রাস্ট্রিতে যাওয়া উচিৎ”। তিনি এও বলতেন, “তোমাকে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই শুধুমাত্র তোমার কমিউনিকেশন্স টা একটু ভাল করতে হবে।” যদিও একদিনে সেটা হয় নাই, এর পিছনে অনেক গল্প আছে, এই দুর্বলতার জন্য আমাকে একবার ঝামেলাতেও পরতে হয়েছিল। আমি একজন অতি সাধারন মানুষ। মন যা চায় সেটাই করি, কে কিভাবে নেবে সেটার বিচার করি না। আমি যেটা করতে সাচ্ছন্দ বোধকরি সেটাই করি। আর সেই কারনেই, Arizona State University (ASU) (যদিও তাদের অনুরোধে ২ সেমিস্টার ক্লাশ নিতে হয়েছিল অনলাইনে) এর চাকুরী ছেড়ে Northern Kentucky University (NKU) এর মত ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলাম, তারপর আমি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি University of Alabama at Birmingham (UAB)। বর্তমানে কর্মরত আছি ফ্লোরিডার Florida Gulf Coast University (FGCU) তে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। আমি আমার নিজের বিশ্বাসে সর্বদা অটল থাকার চেস্টা করি, নিজেকে অনেক বেশি সম্মান করি, ভালবাসি, পাশাপাশি ভালবাসি মানুষকে, কারণ সৃষ্টিকে ভাল না বাসলে স্রষ্টার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। আর একটা জিনিসে সর্বদা চেস্টা করি, সেটা হল ধৈর্য ধারণ করা। এর ফলাফল সবসময়ই ভাল হয়। এত কিছু বলার কারন হল, সর্বদা নিজেকে জানতে হবে আমি কি চাই বা আমি কি করতে পারি। কে কি করছে বা কি করতে পারে তার পানে না তাকিয়ে নিজ কাজে মনোনিবেশ করাই শ্রেয়। সবাই বিসিএস দিচ্ছে তাই আমাকেও দিতে হবে বা সবাই সরকারী চাকুরীর পিছনে ছুটছে তাই আমাকেও তাদের সাথে দৌড়াতে হবে আমার কাছে এর কোনই অর্থ নাই। লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই। আর আমেরিকা জ্ঞানের কদর করতে জানে খুব ভালভাবেই, তাই তারা আজ এখানে অবস্থান করছে। পা-চাটা, চামচামি, তৈল মর্দন এর কোন স্থান নেই এখানে। একটা কথা আছে, “Survival of the fittest”, এরা এটা পুরপুরি ভাবেই ব্যবহার করে এখানে।
ভাল থাকবেন সবাই, আর আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। একটা মেয়ে আছে আমার আলহামদুলিল্লাহ, সে খুবই দুষ্টু এবং মিস্টি। এখন একটু রাত জাগা কমিয়েছে সে! মনেপরে সেই কেনটাকিতে থাকাকালীন রাতগুলোর কথা। রাত ২-৩ টার সময় বলতেন, “বাবা চল ড্যান্স করি” আর তাই ইচ্ছা না থাকলেও বেসুরো গলায় গাইতে হতো কাঁচা বাদাম গান আর সাথে ড্যান্স” দিতে হয়। দিন শেষে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি মুসলিম বাবা-মায়ের মুসলিম সন্তান এবং আমি একজন বাবা, একজন স্বামী। বিদেশে উচ্চ শিক্ষা বা রিসার্স বিষয়ক যদি কিছু জানতে চান, দ্বিধা না করে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন আমার সাথে। মাধ্যমগুলো নিচে দেয়া আছে।
আল্লাহ্ হাফেজ।
Md Shohel Rana, Ph.D.
Assistant Professor । Computing and Software Engineering
Member of IEEE, IEEE Society & ACM
Florida Gulf Coast University (FGCU)
10501 FGCU Boulevard South, Fort Myers, FL 33965
P: 239.745.4513 | E: mrana@fgcu.edu | W: www.msrana.info