কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় উড়তে দেখা যায় একটি চীনা বেলুন। আমেরিকার পক্ষ থেকে বেলুনটিকে ‘গুপ্তচর বেলুন’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও চীন দাবি করে, এটি ছিল ‘আবহাওয়া পর্যবেক্ষক বেলুন’। আমেরিকার আকাশে কয়েক দিন ধরে ওড়ার পর শেষ পর্যন্ত বেলুনটিকে ভূপতিত করেন মার্কিন কর্মকর্তারা। চলমান বৈশ্বিক সংকটের পৃষ্ঠদেশে দাঁড়িয়ে মার্কিন ‘কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা’কে ফাঁকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বেলুন ঢুকে পড়ার এই ঘটনাকে ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হিসেবে মানতে নারাজ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহল। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা। সত্যিকার অর্থে এই ‘বেলুন কাণ্ড’ বিশ্বের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, সে বিষয়ে সুলুকসন্ধান করেছেন সুমৃৎ খান সুজন
সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রেবুয়ারি মাস এলেই যেন উত্তাপ বাড়ছে বিশ্ব অঙ্গনে! গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ, যার হাত ধরে বিশ্বকে ঘিরে ধরে চরম স্থবিরতা। ২০২৩-র ফেব্রুয়ারিও বয়ে এনেছে ‘উত্তেজনা’। ‘বেলুন কাণ্ড’ নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গেছে চারদিকে। ফেব্রুয়ারি মাসেই কেন চীনের বেলুন উড়তে উড়তে আমেরিকার আকাশে ঢুকে গেল—এই ‘রহস্যজনক’ প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছেন অনেকেই। চীনা বেলুন (যা আদতে এন্ডোটমস্ফিয়ারিক স্যাটেলাইট) যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ সীমায় অযাচিতভাবে প্রবেশ করা নিয়ে যে ধুন্ধুমার রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে, তার গ্রহণযোগ্য কূলকিনারার দরকার আছে বৈকি। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ঘটনাটি সম্ভবত ঘটেছে এই কারণে যে, বেইজিং হয়তো বা দেখতে চায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারে আসলে কী চলছে? খুব সম্ভব এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা থেকেই আমেরিকার আকাশে ‘স্পাই বেলুন’ পাঠানো হতে পারে।
উল্লেখ্য, চীনের এ ধরনের তৎপরতার পর নিরাপত্তা ও কৌশলগত প্রশ্নে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ‘বেলুনের গুরুত্ব’। যে যাই বলুন না কেন, প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, ‘বেলুন’ গোয়েন্দা নজরদারির প্রাচীনতম পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে অগ্নিসংযোগ ও বোমা হামলা করতে ব্যাপক হারে বেলুনের ব্যবহার করেছিল জাপানিরা। স্নায়ুযুদ্ধের কালে কঠোর নজরদারি চালাতে বেলুন ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। ‘বেলুন অস্ত্র’ ব্যবহারে পিছিয়ে ছিল না সোভিয়েত ইউনিয়নও। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বেলুনের সাম্প্রতিক উপস্থিতির পর এটা মনে করা বাড়াবাড়ি হবে না যে, নজরদারি চালানোর ক্ষেত্রে ‘বেলুন কৌশল’ কি তবে ফিরে এসেছে! এমনটা মনে করার পেছনে যুক্তিও আছে। পেন্টাগনের নেটওয়ার্কে এ ধরনের বেলুন যুক্ত করার কথা বিবেচনা করছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, আধুনিক বেলুনগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৪ থেকে ৩৭ কিলোমিটার তথা ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ফুট উঁচুতে উড়তে সক্ষম। বিশ্লেষকরা বলছেন, আধুনিক স্যাটেলাইট বা ড্রোনের তুলনায় বেলুনের বেশ কিছু বাড়তি কিছু সুবিধা রয়েছে। বেলুন কম ব্যয়বহুল তো বটেই, উপরন্তু খুব সহজেই মোতায়েনযোগ্য। যেখানে স্যাটেলাইট কেবল নিজের কক্ষপথেই ঘুরতে পারে, সেখানে বেলুন পাঠানো যায় ইচ্ছেমতো জায়গায়। তাছাড়া বেলুনের বিশেষ সুবিধা হলো, ড্রোনের তুলনায় অনেক ধীরগতিতে ওড়ে বলে এর সাহায্যে লম্বা সময় ধরে লক্ষ্যবস্তুতে নজরদারি চালানো যায়।
চলমান ‘বেলুন কাণ্ড’ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার বিলিংস শহরের আকাশে সর্বপ্রথম দেখা যাওয়ার আগে বেলুনটি আলাস্কার অ্যালেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং কানাডার ওপর দিয়ে উড়ে এসেছে। এই ঘটনার পর চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে বেলুনটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। তবে কোনোভাবে তা নির্দিষ্ট পথ থেকে সরিয়ে গিয়ে বাতাসে ভেসে আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছায়। চীনের এই ব্যাখায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেউ কেউ চীনের দাবি মেনে নিলেও মার্কিন বিশ্লেষকরা একে উল্লেখ করেছেন ‘অস্বাভাবিক বিষয়’ হিসেবে। বিশেষ করে কয়েক দিন ধরে এরকম একটি বেলুনের আকাশে ওড়াটা বেশ অস্বাভাবিক। সত্যি বলতে দীর্ঘ সময় ধরে অতি উচ্চতায় বেলুনটিকে যেভাবে উড়তে দেখা গেছে তাতে মার্কিন বিশ্লেষকদের সঙ্গে একমত পোষণ না করে উপায় নেই! কিংস কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষা-বিষয়ক গবেষক ড. মারিনা মিরন যেমনটি বলছেন, ‘চীনের বক্তব্যকে শতভাগ মেনে নেওয়াটা কঠিন। কেননা, অত্যাধুনিক বেলুনটি হয়তো ভূ-পৃষ্ঠ থেকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকতে পারে। বেলুনটিকে কখনো উঁচুতে তুলে আবার কখনো নিচে নামিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকতে পারে, যাতে বাতাসের বহুমুখী গতি ব্যবহার করে বিভিন্ন দিকে যেতে পারে।’ কার্নেজ কাউন্সিল ফর এথিকস ইন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষক আর্থার হল্যান্ড মাইকেল মনে করেন—‘এমন হতে পারে, বেলুনটা শনাক্ত হওয়াটাই চীনের উদ্দেশ্য ছিল। বেইজিং হয়তো দেখাতে চায় যে, তাদের এমন সব স্পর্শকাতর প্রযুক্তি আছে, যা বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি না করেও যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে পারে অনায়াসে।’ তবে ঘটনা যাই হোক, চীনের দাবি অনুযায়ী আবহাওয়া মনিটরিংয়ের কাজে সত্যিই ব্যবহৃত হয়ে থাকলে বেলুনটির এতটা উঁচুতে এত দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারার কথা নয়—এ ধরনের কথাই বলছেন প্রথমসারির আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞগণ।
বলা বাহুল্য, বেলুন কাণ্ডের পর নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়েছে মার্কিন-চীন সম্পর্কে। ঘটনার পর বহুল প্রত্যাশিত চীন সফর স্থগিত করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। অর্থাৎ অমীমাংসিত নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে চীন-মার্কিন সম্পর্কে যে ফাটল সৃষ্টি হয়ে আছে, বেলুন কাণ্ডের পর তা আরো বড় হলো। বিশ্লেষকরা ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘বেইজিং হয়তো ওয়াশিংটনকে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, আমরা যেমন সম্পর্ক ভালো করতে চাই, তেমনি যে কোনো রকমেই হোক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যও প্রস্তুত আছি।’
উল্লেখ করতে হয়, বিশ্বের অনেকের দৃষ্টিতে আমেরিকার বর্তমান রাজনীতিকে খুব একটা ‘স্থিতিশীল’ বলে মনে হচ্ছে না। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের মধ্যে আদতে কী ঘটছে, তা জানার চেষ্টা থেকেই বেলুন পাঠানো হয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। ভুলে গেলে চলবে না, চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১ নম্বর কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী। ইদানীং এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের প্রথম দিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে! ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে চীনের বেলুন আমেরিকার আকাশে উড়ে যাওয়ার ঘটনা উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে দিল!
বিশ্ব রাজনীতির সাম্প্রতিক হালচালে এটা স্পষ্ট, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার) গড়তে কতিপয় বিশ্বনেতা ‘অস্থির’ হয়ে পড়েছেন! এক অর্থে ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’র জন্ম হচ্ছে যেন আমাদের চোখের সামনেই! যেমন—হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে দেশের মানচিত্রকে নতুন করে আঁকতে ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। এর ফলে বিশ্বের প্রতিটি দেশ পড়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম সংকট-অস্থিরতার মুখে। এমন এক অবস্থায়—যখন রাশিয়ার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছে চীন ও কয়েকটি দেশ—চীন নতুন সংকট ডেকে আনলে তা হবে অতি দুঃখজনক। মানতে হবে, আজকের চীন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে অনেক দূর এগিয়ে গেছে শি জিন পিংয়ের চীন। একই সঙ্গে বিপুল সম্পদ ব্যয়ে আধুনিক সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছে দেশটি। এই বাহিনী তাইওয়ান বা এমনকি জাপান বা ভারতের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ করার কথা বলে থাকে হরহামেশা!
মার্কিন সামরিক নেতাদের সাম্প্রতিক মন্তব্য অনুযায়ী, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলায় তথা ইউক্রেনের প্রতি আমেরিকার ‘খোলামেলা সমর্থন’ সম্ভবত রাশিয়ার পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও আমেরিকার সম্পর্কের টানাপড়েনকে খাদের কিনারায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। এর পেছনে আরেকটি বড় কারণ ‘তাইওয়ান ইস্যু’। বেইজিং সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করছে যে, রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধ এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে (২০২৫ সালের মধ্যে মার্কিন-চীন যুদ্ধের ভবিষ্যতবাণী) চীনের সঙ্গে সংঘর্ষের ইঙ্গিত ‘নিছক কথার কথা’ কি না? এদিক থেকে বিবেচনা করলে আমেরিকার সীমানায় চীনের বেলুনকে কী শুধু বেলুন হিসেবে বিবেচনা করাটা যুক্তিযুক্ত হবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বে ধারাবাহিকভাবে যে সব ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে তাতে আমেরিকাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। চীন আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা চালালে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে ওয়াশিংটনকে অবশ্যই শান্ত থাকতে হবে। পরমাণু অস্ত্র তাক করে বসে থাকা রাশিয়ার তাণ্ডবের মধ্যেই চীন যদি নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়, তবে তা হবে বিশ্বের জন্য নিঃসন্দেহে ‘বড় অশনি সংকেত’।
সামনের দিনগুলোতে আসলে কী ঘটতে চলেছে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারাটা বেশ মুশকিল। তবে যুদ্ধের জ্বালামুখে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে এটা এক প্রকার স্পষ্ট যে, বৃহৎ শক্তিগুলো ‘শক্তি পরীক্ষার লড়াই’ শুরু করেছে! সুপার পাওয়ারগুলো যেন বলতে চাইছে—একবিংশ শতাব্দীর ‘শক্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতা’য় আপনাকে স্বাগতম!