চুকাই, চুকুরি, মেস্তা, হড়গড়া, হইলফা বাংলাদেশের নানা প্রান্তে একেক নামে পরিচিত ফলটি। এর রয়েছে আরো অনেক নাম যা বলে শেষ করা যাবে না। এটি সারা বাংলাদেশজুড়ে হয়। তবে ইদানীং বাংলাদেশে রোজেলা হিসেবে বেশ পরিচিতি পাচ্ছে।
বিশ্বের কিছু এলাকায় হিবিস্কাস টি হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে।
শহরে কাঁচাবাজারে গিয়ে আপনারা অনেকেই হয়ত দেখেছেন ঝুড়িতে নিয়ে বিক্রেতা বসে আছেন, খয়েরি ধাঁচের লাল, দেখলে প্রথমে ফুল বলে মনে হয় কিন্তু আসলে এটি একটি ফল।
বাংলাদেশে এর ব্যবহার
বৈজ্ঞানিক নাম রোজেলা এবং সেই নামেই বিশ্বের অনেক দেশে এটি পরিচিত। বাংলাদেশে অবশ্য এটি নতুন কিছু নয়। এর রয়েছে নানা রকম ব্যবহার।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকার শাহিন আক্তারের পরিবারের সবার পছন্দের খাবার এটি। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা এটা ভর্তা করে খাই, ছোট মাছের মধ্যে দেই। শুধু এই ফল দিয়ে একটা টক ঝোল তরকারি রান্না করা হয়। এটা দিয়ে আচারও বানানো যায়।’
‘আমরা খাই, কারণ খেতে ভাল লাগে তাই। ঠিকভাবে রান্না করতে পারতে হবে। বেশি দিয়ে ফেললে অনেক টক হয়ে যায়। কিন্তু আশপাশে অনেকে ওষুধ হিসেবেও খায়।’
ফলটি দিয়ে ডাল রান্না করা যায়।
স্বাদে টক বলে ইদানীংকালে এই ফল দিয়ে অনেকে জ্যাম ও জেলি বানিয়ে থাকেন।
এর গাছের পাতাও শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়।
পুষ্টিগুণ এবং ঔষুধি ব্যাবহার
পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বলছেন, এ ফলটি ভিটামিন-সি দিয়ে ভরপুর।
এতে রয়েছে ভিটামিন-এ, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম এবং একটা ভালো ধরনের প্রোটিন।
এর পাতারও রয়েছে একই ধরনের পুষ্টিগুণ।
এই কারণে এর অনেক ঔষুধি গুন রয়েছে বলে মনে করা হয়।
এতে রয়েছে হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং হার্টের জন্য উপকারী পুষ্টিগুণ।
এটি ত্বকের অসুখ রোধ করে।
কেটে নয়, আস্ত শুকানোর কারণে শুকনো চায়ের মধ্যেও ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট অনেকটাই রয়ে যায়।
নাটোরের এক কৃষক
নাটোরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম ৩০ বছর ধরে ঔষুধি গাছের চাষ করে আসছেন।
গত দুই বছর হলো তিনি বাণিজ্যিকভাবে রোজেলা চাষ করছেন। তবে তিনি এটি কাঁচা নয়, শুকিয়ে চা তৈরি করে বিক্রি করছেন।
কীভাবে শুরু করলেন সে সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, ”এই গাছ আমাদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই ছিল। আমি পেশায় কৃষক সারাজীবন। বছর দুয়েক আগে একটা এনজিও’র কাছে ধারণা পেলাম যে এটা বাণিজ্যিকভাবে কিভাবে চাষ করা হয়। তারা আমাকে সাহায্য করেছে। প্রথম আমার নিজের জমিতে অল্প কিছু চাষ করেছিলাম। পরে আমার জমির আশপাশে অন্য চাষিদের জায়গাতেও করেছি। এই বছর নয় বিঘা জমিতে লাগিয়েছি।”
তিনি বলছিলেন, গাছটিতে খুব বেশি পানি লাগে না। বেশি রোদ দরকার হয়। বর্ষা ও শীত এর প্রধান মৌসুম।
একটি নির্দিষ্ট লাল রঙ হওয়ার পর ফলগুলো উঠানো হয়।
ফল থেকে বীজগুলো বের করে ফেলা হয়।
এরপর হালকা পানি ছিটিয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে দিয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এটি শুকানো হয়।
এরপর মোড়কজাত করা হয়। বাইরের আর্দ্রতার কারণে এটি রোদে শুকালে স্বাদ ও গন্ধ ভালো পাওয়া যায় না।
২০ কেজি কাঁচা ফল শুকিয়ে এক কেজির মতো শুকনো রোজেলা পাওয়া যায়।
তিনি জানিয়েছেন, এক কেজি শুকনো চা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকায়। খুচরা বিক্রি হয় আরো বেশি দামে।
এক টুকরো চা বা শুকনো ফলের দাম ৩০ টাকা।
মূলত ফেসবুকে বিক্রি করেন তিনি।
তার বাগানে এসেও কেনেন অনেকে।
তিনি বলছেন, ‘এর যে ঔষুধি গুণ আছে বলে মনে করা হয়, এ জন্য এটি অনেকেই কিনছেন।’
ফলটির বাণিজ্যিক চাষে সম্ভাবনা
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট সম্প্রতি রোজেলা চা বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
পাট পাতা দিয়ে চায়ের উদ্ভাবক বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের উপদেষ্টা এইচ এম ইসমাইল খান বলছেন, শুকিয়ে চা হিসেবে খাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বের অনেক দেশে রোজেলা চা বা শরবত হিসেবে এটি খাওয়া হয়।
ঢাকায় অনেক দোকানে ইদানীং বিদেশ থেকে আমদানি করা রোজেলা চা পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু আমদানির কোনো অর্থ হয় না কারণ বাংলাদেশেই এটি খুব ভালভাবে চাষ করা সম্ভব।
তিনি বলছেন, মিসরসহ আফ্রিকার অনেক দেশে কেউ বাড়িতে বেড়াতে এলে আপ্যায়নের সময়, হোটেলে রেস্তোরাঁয় ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে ঠাণ্ডা করে গ্লাসে এটা সবসময় দেয়া হয়।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেও এটি জনপ্রিয়।
এর বেশ রফতানি সম্ভাবনা রয়েছে।
তার ভাষায়, ‘সেটি মাথায় রেখে যদি এর চাষ বাড়ানো যায়, তাহলে নতুন একটি রপ্তানি পণ্য পেতে পারে বাংলাদেশ।’
পশ্চিমা বিশ্বের বাজারে রফতানির চেষ্টা আমরা কেন করবো না, বলছিলেন তিনি।
ইসমাইল খান বলেন, ‘চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ দুটোই বাংলাদেশে খুব সহজ। দেশেও যেহেতু এটি অনেক জনপ্রিয়, শুধু দেশের জন্যেও বাণিজ্যিক চাষ হতে পারে। এর ঔষুধি গুণাবলির জন্যে চাষ হতে
পারে। সফট ড্রিংক হিসেবেও বিক্রি হতে পারে। এটি কসমেটিক এবং সাবানেও ব্যবহৃত হয়। সব দিক দিয়ে এটি লাভজনক।’
‘এটি যেহেতু পাট প্রজাতির গাছ, তার মানে এটি উৎপাদনের জন্য চমৎকার মাটি ও আবহাওয়া বাংলাদেশে রয়েছে। দেশে তোষা ও বাংলা পাট নামে যেগুলো পরিচিত সেগুলো যদি ৭০ শতাংশ আর মেস্তা যদি ৩০ শতাংশও চাষ করা হয় তাহলেও এর দ্বারা কৃষকেরা উপকৃত হবেন। কারণ এর তিনটি অংশই ব্যবহারযোগ্য- পাতা, আঁশ এবং ফল তিনটিই কাজে লাগানো যাবে। তবে ফলটির মূল্য সবচেয়ে বেশি।’
দেশীয় ফসল ও চাষ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সমন্বয়কারী দেলোয়ার জাহান বলছেন, দেশজুড়ে গ্রামাঞ্চলে, ঝোপঝাড় অথবা বাড়ির উঠানের এক কোনায় এটি পাওয়া যায়।
তবে পাহাড়ে এর ব্যাপক বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে।
‘আমরা ছোটবেলা থেকে তরকারিতে খেয়েছি। এখনও খাই। কিন্তু ইদানীং ঢাকায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেকেই এখন এটি কিনছেন। অনেকে দেখছি এটি দিয়ে আজকাল জ্যাম ও জেলি বানাচ্ছেন।’
তিনি বলছেন, ‘আমরা যেমন শাক আটি ধরে বিক্রি করি পাহাড়ে সেভাবে বিক্রি হয়। প্রথমে খাওয়া শুরু হয় গাছ একদম কচি থাকা অবস্থায়। গাছ কিছুটা বড় হলে ডালসহ বিক্রি হয় পাতা খাওয়ার জন্য। ঢাকায় যেগুলো কিনতে পাওয়া যায় তা মূলত পাহাড় থেকেই আসে।’