পেলে তার দেশ ব্রাজিলকে কোন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল তা ব্রাজিলের চেয়ে আর কে বেশি বুঝবে। পেলেকে কীভাবে সারা জীবন বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই চিন্তা ব্রাজিল করেছিল। ফুটবল সম্রাটকে সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে পেলের নামে জাদুঘর বানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব্রাজিলের বিখ্যাত স্থপতি অস্কার নেইমারকে পেলের নামে জাদুঘর বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সংগ্রহ করা হয় পেলের ফুটবল ক্যারিয়ারের যত স্মৃতি রয়েছে তার সবকিছু। বুট থেকে শুরু করে তার জীবনের যা কিছু আছে, বিশ্বকাপ জয় করা পর্যন্ত, সবই সেখানে রাখা হয়। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর জাদুঘর উদ্বোধন হয় ২০১৪ সালে।
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ কাভার করতে ব্রাজিলে গেলেও পেলের জাদুঘর দেখার সুযোগ হয়নি। ২০১৬ সালে ব্রাজিলে রিও অলিম্পিক গেমস কাভার করতে যাওয়ার সুযোগে পেলের জাদুঘরে যাওয়ার সুযোগ এসে যায়। সান্তোস শহরে পেলের জাদুঘর। সান্তোস ক্লাব থেকে কিছুটা দূরে। ট্যাক্সি ড্রাইভারের কারণেই পেলের জাদুঘর দেখার সুযোগ এসেছিল।
টিকিট কেটে ঢুকতে হয় জাদুঘরে। ঢুকলে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে যাবেন একজন দর্শনার্থী। ফুটবল খেলোয়াড়কে বাঁচিয়ে রাখতে এত সুন্দর পরিকল্পনা করে সাজানো হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। টিকিট কেটে ঢুকলেই ডানদিকে পেলের নামে নানা ধরনের সুভেনির বিক্রি হচ্ছে। বাঁ দিকে পেলের খেলা দেখার জন্য বড় পর্দা।
বেরিয়ে সামনে এগুলে স্ন্যাকসের দোকান। তখনো মূল জাদুঘরে প্রবেশ করা হয়নি। ঢুকলে চার দিকটা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। কী নেই সেখানে। পেলের ফুটবল ক্যারিয়ারের যত ছবি সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। পেলের জার্সি, বুট, প্যান্ট, ট্র্যাকস্যুট সবই আছে। পেলের ব্যবহারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র শোভা পাচ্ছে। পেলেকে নিয়ে নানা ধরনের পেপার কার্টিং। বিশ্বকাপ জয়ের ট্রফির ছবি। কোথায় কোথায় খেলেছেন ম্যাচ জিতেছেন। যেসব রেকর্ড গড়েছেন তার সবই দেখা যায়।
ব্রাজিলিয়ান ফুটবল সুপারস্টার সান্তোস ক্লাবে খেলতে শুরু করেছিলেন ১৫ বছর বয়সে। ২৮ বছর খেলেছেন এই ক্লাবে। নিয়ে গেছেন অন্যান্য উচ্চতায়। পেলে এনে দিয়েছেন যত সাফল্য। রেকর্ড বলছে, ১৮ বছরে ৬৫৯ ম্যাচ খেলে ৬৪৩টি গোল করেছেন পেলে। সান্তোস ক্লাবকে এনে দিয়েছেন ২৬টা ট্রফি। পেলের কারণেই যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকরা সান্তোস এফসি নামটা মুখস্ত রেখেছে। এই ক্লাবে খেলার এক বছর পরই, ১৬ বছর বয়সে ব্রাজিল জাতীয় দলে ঢোকেন এবং ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। এরপর ১৯৬২ এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় পেলের ব্রাজিল। জাতীয় দলে ৯২ ম্যাচ খেলে ৭৭ গোল করেছেন ফুটবলের কালো মানিক পেলে। ফুটবলকে যেভাবে দিয়েছেন ফুটবল তাকে দুই হাত ভরে দিয়েছে। ব্রাজিলে ফুটবল নিয়েই নয়, যে কোনো খেলা নিয়ে আলোচনা করলে পেলেকে তারা মাথায় রেখে কথা বলেন। ব্রাজিলিয়ানরা তাকে ফুটবলের ঈশ্বর মনে করেন। মনে করেন পেলে তার পায়ের জাদু দেখিয়ে এই গ্রহে ফুটবল খেলাটাকে জনপ্রিয় করেছেন। পেলের আগে পরে যেসব ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার খেলেছেন তাদের অনেক অবদান থাকলেও পেলে ফুটবলের রংটা বদলে দিয়েছেন। বিশ্ব জুড়ে মানুষের মনে ব্রাজিলকে গেঁথে দিয়েছেন ফুটবলের দেশ হিসেবে। এই মানুষটাকে সারা জীবন বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে জাদুঘর তৈরি করে।
জাদুঘরের নিচ তলা থেকে স্কেলেটরে চড়ে দোতলায় উঠতে হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় টিভি মনিটর। আপনি চাইলে মনিটর ঘুরিয়ে পেলের পুরো নৈপুণ্য দেখতে পারবেন। লেখা আছে কোন বিশ্বকাপের খেলা দেখতে চান। পেলের স্মৃতিময় গোলটা দেখতে চান। পেলের শত গোলের শট দেখা যাবে। এসব দেখতে দেখতে আপনি ফুটবল দুনিয়ার রঙিন ঘোরে মাতাল হয়ে যাবেন। মনে হবে পেলের জন্ম না হলে ফুটবলেরই জন্ম হতো না। পাঠ্যপুস্তকের বইয়ে ‘ফুটবলের কালো মানিক পেলের জীবনী পড়ে মনের আঙিনায় তাকে দেখার যে রোমাঞ্চের শুরুটা হয়েছিল, তার পূর্ণতা পায় জাদুঘর দেখে। ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে কয়েক ঘণ্টা। এরই মধ্যে নিরাপত্তা অফিসারের ডাক আসল পর্তুগিজ ভাষায়। না বুঝলেও বোঝা গেল বেরিয়ে যেতে বলল। তিন তলা দেখার সুযোগ মিলল না। বিদায়ের পথে পেছনে ফেলে আসা ছবিগুলো চোখে আঠার মতো লেগেছিল। পেলের জাদুঘর দেখার স্বর্ণালী মুহূর্তগুলোর রোমাঞ্চটা গায়ে মেখে থাকল কয়েক বছর।