আজ ৬ সেপ্টেম্বর। ঢাকাই চলচ্চিত্রের সেই বিভীষিকাময় দিন। আজকের দিনেই দেশীয় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক, অনেক নায়কের অনুপ্রেরণা, ফ্যাশন আইকন, মেধাবী অভিনেতা সালমান শাহের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। সালমানের মৃত্যুবার্ষিকী এলেই যেন সিলেট শহরের দাড়িয়াপাড়ার নানার বাসাতে তার ভক্তদের আসা-যাওয়াটা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। গত ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে সালমান শাহের নানার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, গেটের সামনে দাঁড়িয়েই কয়েকজন ছবি তুলছেন। কারণ এই বাসাতেই অর্থাৎ এই ‘সালমান শাহ হাউস’-এ কেটেছে নায়ক সালমানের ছোটবেলা। দুরন্ত সময়টা তিনি সেখানেই কাটিয়েছেন। জানালেন তার মামা কুমকুম। বাসার সামনেই সালমান শাহের ভিড়ের মধ্যে থেকে জানতে চাইলাম তাদের সম্পর্কে, কে কোথা থেকে এসেছেন। একজন বললেন, তার ছোটবেলা কেটেছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে। সেখানে শুটিং হয়েছিল প্রয়াত শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘আনন্দ অশ্রু’ সিনেমার। সালটা ১৯৯৫। মধুপুরের সন্তান শাকিল আহমেদ প্রিন্স। মধুপুরের কাকরাইদের বিএডিসি ফার্মেই মূলত শুটিং হয়েছিল। প্রিন্স বলেন, যেহেতু আমার নানা নূরুল ইসলাম রাজ এই সিনেমার প্রযোজক ছিলেন, তাই আমার প্রিয় নায়ক সালমান শাহকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
সেই সময় কাছে দেখার সুযোগ হয়েছিল শাবনূর, ডলি জহুর, হুমায়ূন ফরীদি, নানা শাহ’সহ আরো অনেককে। আমার খুব মনে পড়ে সেই সময় ক্রিকেট খেলা বিএডিসি ফার্মের বাংলোতে বসে সালমান শাহের সঙ্গে খেলা উপভোগ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। খুব মনে পড়ে আমার নানার একটি লাল এক্সেল হুন্ডা ছিল। সেটা সালমান শাহের খুব প্রিয় ছিল। সেই হুন্ডা তিনি শুটিংয়ের সময়ের ফাঁকে ফাঁকে চালাতেন। খুব মধুর ছিল সেই সময়টা। এত জনপ্রিয় একজন নায়ক ছিলেন তিনি, কিন্তু তার মধ্যে বাচ্চাসুলভ আচরণটাই মুগ্ধ করেছিল আমাকে। তার অকাল প্রয়াণে সবাই যেমন কষ্ট পেয়েছিলেন, আমার কেন যেন মনে হতো আমিই বোধহয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ তার সঙ্গে এত কাছে এসে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল আমার। যে আমি সেটা আজও মানতে পারিনি যে তিনি নেই। তাই সিলেটে এসে তার স্মৃতিচিহ্নটা দেখতে এলাম। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন।
মাঝে মাঝে মনে হয় ইশ! তিনি যদি আবার ফিরে আসতেন তাহলে নিশ্চয়ই আমি তার সঙ্গে দেখা করতাম, আনন্দ অশ্রু সিনেমার সময়কালের স্মৃতিচারণ করতাম। নিশ্চয়ই তিনি আমাকে চিনতে পারতেন। কত কিছুই আসলে ভাবি সালমান শাহকে নিয়ে। প্রিন্সের মতো আরো এমন অনেক ভক্ত আছেন যারা একবার সিলেটে যান তারা তাদের প্রিয় নায়কের কবরে যান, কবর জিয়ারত করেন। আবার প্রিয় নায়কের নানার বাড়িও ঘুরে যান।
বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাস সৃষ্টিকারী নায়ক সালমান শাহ। দেখতে দেখতে তার মৃত্যুর ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। মৃত্যুর ২৫ বছর পরও তিনি এখনো আকাশচুম্বী জনপ্রিয়। এখনো টিভি পর্দায় তার সিনেমা প্রচার হলে দর্শক আগ্রহ নিয়ে দেখেন। এখনো তার অভিনীত সিনেমার গান টিভিতে প্রচার হলে তা দর্শক এড়িয়ে যেতে পারেন না। এমনও দেখা গেছে, পাশাপাশি দুটি চ্যানেলের একটিতে নতুন কোনো সিনেমা প্রচার হচ্ছে আবার অন্যটিতে সালমান শাহের সিনেমা প্রচার হচ্ছে। এর মধ্যে দর্শক সালমান শাহের সিনেমা দেখার প্রতিই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন। আবার শুধু সালমান শাহের সিনেমার ক্ষেত্রেই এমন দেখা গেছে, সিনেমা প্রচারের সময় দর্শক শুধু সালমান শাহের পারফরম্যান্সই বেশি উপভোগ করেন। তার সঙ্গে কে আছেন তা কখনোই জরুরি কোনো বিষয় নয় দর্শকের কাছে। মৃত্যুর এত বছর পরও সালমান শুধু তার দুর্দান্ত অভিনয় এবং ফ্যাশনে ভিন্নমাত্রা দিয়েই দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে আছেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতার সঙ্গে সালমান শাহ চারটি সিনেমাতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সিনেমাগুলো হচ্ছে বাদল খন্দকারের ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, দীলিপ সোমের ‘মহামিলন’, শিবলী সাদিকের ‘মায়ের অধিকার’ ও জাকির হোসেন রাজুর ‘জীবন সংসার’। দুটি সিনেমাতে সালমানের মায়ের ভূমিকায় এবং দুটি সিনেমায় সালমানের ভাবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ববিতা। দীলিপ সোমের ‘মহামিলন’ সিনেমার শুটিংয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ববিতা বলেন, ‘কক্সবাজারে এই সিনেমার শুটিং হয়েছিল। একটি দৃশ্য ধারণ করা হচ্ছিল পাহাড়ের ওপর। আমার হাতে পিস্তল ছিল। দৃশ্যটিতে শুটিংয়ে অংশ নিয়েছিলাম আমি, রাজীব ভাই, শারমিন, সালমান শাহ ও শাবনূর। সেই দৃশ্যটি ধারণের নানা সময়ে আমি শুটিংয়ে আনা অন্য একটি চেয়ারে বসি। কারণ হোটেল থেকে আমার চেয়ারটি নিতে মনে ছিল না। সালমান বিষয়টি খেয়াল করে এবং শুটিংয়ে তার নেওয়া চেয়ারটি আমাকে গিফট করে। আমি না করার পরও সালমান তার নিজের ব্যবহৃত চেয়ারটি তখনই আমাকে গিফট করে। সেই চেয়ারটি দীর্ঘদিন আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল।
তারপর আবার যখন মোবাইল প্রথম বাজারে এলো। সেই সময় সাইজে মোবাইল অনেক বড় ছিল। তো আমি সেই মোবাইল ব্যবহার করতে পারতাম না। সালমানই আমাকে একটি চিরকুটে মোবাইল ব্যবহার করার পদ্ধতি প্রথম শিখিয়ে দিয়েছিল। যে কারণে পরবর্তী সময়ে মোবাইল ব্যবহার করা আমার কাছে বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিল। তো সালমানের নিজের হাতের লেখা সেই চিরকুটটি এখনো আমার কাছে বেশ যত্নে রাখা আছে। সেই চিরকুটের মাঝেই আমাদের হারিয়ে যাওয়া সালমানকে খুঁজে বেড়াই। সালমান একটি কথা আমাকে প্রায়ই বলত যে, আপনি আমার আপন মা না হলেও আপনি আমার সুইট মা। মা ছাড়া সে আমাকে অন্য কিছুই আর ডাকত না। সত্যিই এতটা বছর পরও তাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আমি ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে যাই।’
প্রশ্ন রাখি একজন অভিনেতা হিসেবে আপনি সালমানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? জবাবে ববিতা বলেন, ‘সত্যি বলতে কী সালমান শাহ অনেক ভালো অভিনেতা ছিল। পোশাকে ফ্যাশনে নতুনত্ব তো সৃষ্টি করেছিলই, সেটা সবাই দেখেছেন এবং তার ফ্যাশন এখনো অনেকেই ফলো করেন সাধারণ জীবনেও, শিল্পী জীবনেও। এটা অনেক বড় বিষয়। আর অভিনেতা হিসেবে সালমান নিজেই ছিল অনন্য। এমনভাবে সংলাপ বলত, এমনভাবে এক্সপ্রেশন দিতো এটা বুঝার উপায় থাকত না যে অভিনয় নাকি সত্যি। পরিচালকের কাছ থেকে দৃশ্য বুঝে নিয়ে এমনভাবে সংলাপ বলত যে তার সহশিল্পীর জন্যই সেই অভিনয়ের কাউন্টার দেওয়া কঠিন হয়ে যেত। সালমান সত্যিই অনেক বড় মাপের অভিনেতা ছিল। তার মতো অভিনেতার অকাল প্রয়াণ সত্যিই আমাদের জন্য অনেক বেদনার, অনেক কষ্টের। এই কষ্টটা আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে আরো দীর্ঘদিন। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন, আমিন।’
ছোট-বড় সবার প্রিয় নায়ক সালমান শাহের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায়। তার বাবার নাম কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা নীলা চৌধুরী। সালমানের দাদার বাড়ি সিলেট শহরের শেখঘাটে আর নানার বাড়ি দাড়িয়াপাড়ায়। যে বাড়ির নাম এখন ‘সালমান শাহ হাউস’। তার নানা পূর্বপাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এ অভিনয় করেছিলেন। অভিনয়ে সালমানও তাই সেই নানার কারণেই আসা। স্কুলে পড়ার সময় সালমান শাহ বন্ধুমহলে সংগীতশিল্পী হিসেবে বেশ পরিণত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে ছায়ানট থেকে পল্লীগীতিতে পাস করেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে আসার আগেই ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট বিয়ে করেন। স্ত্রী ছিলেন সামিরা হক। যদিও বা সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় অভিনয় করেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পান সালমান শাহ। কিন্তু তার আগেই তিনি নাটকে অভিনয় করেন। অভিনেত্রী সুইটি তার সঙ্গে সালমান শাহের একটি নাটকে অভিনয়ের কথা স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমার প্রথম নাটক ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ সালমান শাহর সঙ্গে। অসম্ভব মেধাবী একজন শিল্পী ছিলেন সালমান শাহ। অসাধারণ মনের মানুষ এবং চমৎকার ছিল তার ব্যবহার। তার আত্নার শান্তি কামনা করছি।”
‘স্বপ্নের পৃথিবী’ নাটকে সালমান শাহ অভিনয় করেছিলেন শুভ চরিত্রে। সেই সময় ‘তোমার প্রেমে আমি অন্ধ, বুঝি না ভালো মন্দ, তোমাকেই ভালোবাসি, তুমি আমার হাসি আনন্দ’ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সুইটি বলেন, ‘সত্যি বলতে কী সালমানের চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল অবাক হলেও সত্যি সেই শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি, পূরণ হবেও না। কিছু কিছু শূন্যতায় কোনোভাবেই পূর্ণতা আসে না।’
মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক ‘পাথর সময়’-এ একটি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সালমান শাহের অভিনয় জীবন শুরু হয়। ওই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে তৌকির আহমেদ অভিনয় করলেও সালমান শাহের চরিত্রটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তী সময়ে আরো বেশকিছু নাটকে অভিনয় করেও দারুণ প্রশংসিত হয়েছিলেন সালমান। সিনেমার পাশাপাশি নাটকেও তার উপস্থিতি দর্শকের মধ্যে ভীষণ সাড়া ফেলেছিল। যদিও বা মৌসুমীর সঙ্গে সিনেমাতে সালমানের অভিষেক হয়। পরে মৌসুমীর সঙ্গে আরো দুটি সিনেমা ‘স্নেহ’, ‘দেনমোহর’, ‘অন্তরে অন্তরে’তে অভিনয় করলেও আর কোনো সিনেমাতে তাদের দেখা যায়নি। শাবনূরের সঙ্গেই বেশি সিনেমাতে অভিনয় করেছেন সালমান শাহ যে জুটিকে এখনো সিনেমার অন্যতম সেরা জুটি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। সালমান শাহের সঙ্গে জুটি হয়ে আরো অভিনয় করেছিলেন শাবনাজ, শাহনাজ, লিমা, শিল্পী, শ্যামা, সোনিয়া, বৃষ্টি, সাবরিনা ও কাঞ্চি।
সালমানের মৃত্যুর পর এই এত বছরে ঢাকাই চলচ্চিত্রে অনেক নায়কের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু কেউই তার জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি, অনেক চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালকের ভাষ্যমতে, সালমান শাহ ছিলেন ধূমকেতুর মতো, এলেন দেখলেন জয় করলেন আবার চলেও গেলেন।
মৃত্যুর এত বছর পরেও ভক্তদের হৃদয়ে এতটা ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোনো দেশের কোনো নায়কের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। যে সময়টাতে সালমান মৃত্যুবরণ করেন, সেই সময়টাতে যারা ছোট ছিলেন তাদের কাছেও ছোটবেলার গল্পের বিষয় ছিলেন সালমান শাহ। তারাও মনে মনে স্বপ্ন দেখেন, ইশ! যদি একবার ফিরে আসতেন সালমান শাহ। কিন্তু মৃত্যুই সত্য, যে চলে যাওয়ার সে চলেই যায় আর ফিরে আসে না কোনোদিন।