দুই বাংলার ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় অভিনেত্রীর নাম জয়া আহসান। সম্প্রতি ৫ম বারের মতো পেলেন সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। এদিকে কলকাতায় তার অভিনীত ‘দশম অবতার’ ছবিটি সম্প্রতি ব্লকবাস্টার হিট করেছে।
বর্তমানে মুক্তির অপেক্ষায় ‘ফারিশতে’ যেটি একজন ইরানি চলচ্চিত্রকারের নির্মাণ, আরেকটি বলিউডের প্রখ্যাত নির্মাতা অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর নির্মাণে চলচ্চিত্র ‘কড়ক সিং’ এই দুটি ছবি। ছবি দুটি নিয়ে গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রয়েছেন তিনি। ফিল্ম ক্রিটিকদের ভেতরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন। ইত্তেফাকের সঙ্গে দীর্ঘ ইন্টারভিউতে কথা বললেন তিনি সমসাময়িক নানান প্রসঙ্গে।
পুরস্কারপ্রাপ্তি সবটাই আনন্দের। তবুও তিন তিনবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জেতা না ৫ বার ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তি। আনন্দের ওজনে কোনটা ভারী বা বেশি মনে হয়? কীভাবে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন—
আসলে ফিল্মফেয়ারকে বলা হয় ভারতের অস্কার। এর ব্যাপ্তিটাও বিশাল। তারপরও এই ৫বার জাতীয় পুরস্কার পেলাম কিংবা একবারও যদি পেতাম, সেটিও আমার কাছে অনেক বড়। কারণ দেখুন এই পুরস্কারটি আমার দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি। রাষ্ট্র আমাকে সম্মান দিচ্ছে। তাই এর ওপরে কোনো কথা হবে না।
‘কড়ক সিং’ সিনেমা হলে রিলিজ পাচ্ছে না বলে কিছুটা মন খারাপ কি আপনার? ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবিতে আপনাকে নিয়মিত দেখা যাবে কি? নাকি এর সাফল্য, ব্যর্থতার ওপর কিছু নির্ভর করবে?
সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে না বলে আমার মন খারাপ, বিষয়টা আসলে তা নয়। এটি আমার প্রথম কোনো ওটিটি রিলিজ, সেটিও হিন্দি ছবি। তাই বিষয়টি আমার কাছে খুবই আনন্দের। আর বাণিজ্যিক ছবি বলতে যা বোঝায়, সেই সংজ্ঞাটা এখন বদলে গেছে। এখন যে টাইপ মিডল ছবি নির্মাণ করা হয়। সেগুলোই কিন্তু মানুষ বেশি দেখছে। আমি বিগত কয়েক বছরে যে টাইপের ছবি করেছি। যেমন ধরুন বিজয়া, বিসর্জন, দশম অবতার যা যা ছবি করেছি…সব কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে ভীষণ সফল। এই ছবিটিও সেরকম।
এ ছবিতে বলিউডের এ সময়ের আলোচিত অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠি আপনার সহ-অভিনেতা। খুবই সম্মানের কাজ। তবুও সাম্প্রতিক বাঁধনের ছবির ইস্যুর পরে অনেকের প্রশ্ন যে, আমাদের তারকাকে কোনো নেগেটিভ চরিত্রে কাজ করানো হলো কি না, যেখানে দেশ খাটো হয়? এমন অবস্থায় আপনার অবস্থান কী থাকে? কড়ক সিং-এ আপনার চরিত্রের গুরুত্ব কতটা?
কড়ক সিং এ তিনটি নারী চরিত্র। এবং এই তিনজনকে নিয়েই গল্প ঘুরপাক খেয়েছে। চরিত্রের প্রয়োজনেই এসেছে সবটুকু। তাই চরিত্রের গুরুত্ব রয়েছে বেশ। আর আমার যেকোনো কাজ, সেটা অভিনয় হোক বা অন্য কিছু—তাতে আমার দেশ যদি খাটো হয়, তাহলে অবশ্যই আমি তা করব না। এটা আমার নিজস্ব দায়বোধের প্রশ্ন।
বারবার আপনাকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে জানি, তাই আবারো প্রশ্ন করি—বিয়ে থা সত্যিই করবেন না। আপনার কি ইচ্ছে করে না সন্তানের মা হতে? নাকি পালক নেবেন। অথবা ভেবে নেব অন্যদের মতো পৃথিবীর কোথাও আপনার গোপন সংসার চলছে। পরে কোনো একসময় জানাবেন? এই মুহূর্তে কোনটি বলার সময় এসেছে, বলুন প্লিজ। সম্পর্ক তৈরিতে বা সম্পর্কে থাকার বিষয়ে আপনার ভয় কাজ করে কি না। নাকি নানাবিধ ভাঙন আর ইগো অল্টার ইগোর দৌরাত্ম্যে আপনার শঙ্কা জাগে, কোনটা? বলবেন প্লিজ…
না না। দেখুন, আমার তো আগে একটা সংসার করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেজন্য আমি ভীষণ ভয় পাই। তাই নতুন করে আরেকটা সম্পর্কে ইনভেস্ট করার জন্য শক্তি ইচ্ছে কোনোটিই আমার নেই। আবার সেই সংসার করব কি না, সেই এনার্জি বা মানসিক চাওয়াটা এখন আর নেই। শুধু কি স্বামী-সন্তান নিয়েই পরিবার হয়? মা-বোনদের নিয়েও তো পরিবার হয়। আর আমার চারপেয়ে যে কুকুরগুলো রয়েছে ওদের নিয়েও আমার পরিবার। ইগো অল্টার ইগো ওসবে ঝামেলা নেই। আমি খুব সহজ মানুষ। হ্যাঁ রাগ আমারও আছে। কিন্তু তার শিল্পীতচর্চা নিয়ে নিজের প্রতি আমার রাগ। আমি অতো পুরুষবিদ্বেষী নই। সত্যি বলতে কী একদমই ইচ্ছে নেই। সেই ভাবনাটাও তৈরি হয় না আর। আপনি যখন জিজ্ঞেস করছেন, তাই বলি। দেখুন আমি যা রোজগার করি, তার একটা বড় অংশ কিন্তু আমি অসহায় পশুপাখিদের জন্য খরচ করি। ঢাকায় বা কলকাতায় ধরুন কোনো অসুস্থ কুকুর পড়ে আছে, বা পাগল হয়ে আছে কিংবা কোনো বাজপাখির ডানা ভেঙে গেছে …ওদের তখন রেসকিউ করি, যাতে খেয়ে দেয়ে আবার স্বাভাবিক হতে পারে সেই উদ্যোগ নিই। দেখুন, মানুষ শুধু মানুষের জন্যই করবে। এটাও কোনো নিয়মের ভেতরে পড়ে না। মানুষের জন্য তো অনেকেই করছেন। আমি না হয় প্রকৃতির জন্য থাকলাম। এগুলো আমি কখনো ফলাও করে বলতে চাই না। সংসারের প্রশ্ন টানলেন। তাই বললাম। এদের নিয়েই আমার সংসার।
আপনি তো ফিলিস্তিনের গাজায় অসহায়দের নিয়েও স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে এ ধরনের সংহতি বা কথা বলাটা শিল্পীর দায়িত্ব বলে মনে করেন কি না—
কথা বলেছি এবং সবসময়ই আমি মানবতার পক্ষে সারাবিশ্বেই কথা বলেছি। আর শিল্পীর দায়িত্ব বললে সেটা ব্র্যাকেটবন্দি হয়ে যায়। আমি বলব পৃথিবীর সচেতন নাগরিক হিসেবেও তা দায়িত্বের ভেতরে পড়ে।
‘দশম অবতার’ ছবিটি ব্লকবাস্টার গেল। আপনার অভিনীত কলকাতার একাধিক ছবি সর্বভারতীয় জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। আপনি হয়তো বাংলাদেশি পাসপোর্ট ধারী বলে মনোনয়ন পাননি। এই যে ওপার বাংলায় সবার কাছে ঈর্ষার পাত্র আপনি। ওখানকার গণমাধ্যমের অনেকেই বলছেন আপনি দ্বিতীয় সুচিত্রা সেন হতে চলেছেন। ভিনদেশি একজন অভিনেতার এই সাকসেস ওরা কীভাবে দেখে? কেউ কেউ ঈর্ষায় আবার বলছেন— আমি বাবা জয়ার মতো অন্য দেশে বাড়ি করে থাকতে পারব না। আবার অনেকেই জয়া হতে চান। এগুলো কেমন লাগে —
সুচিত্রা সেন !! অমন নমস্য ব্যক্তিত্বের সাথে আমার নামটা যায় না!! আমি সত্যিকার অর্থেই এখনো শিল্পী হতে পারিনি। শিল্পী হবার প্রচেষ্টায় আছি। আমি শিল্পী হয়েছি কি না এটা মানুষ বলবে। আর কে কী বলল, সেটা আমার গায়ে লাগে না কখনোই। আমি বরাবরই এমন। আমি ঐ দিনশেষে ক’টা ঝিনুক থেকে নুড়ি কুড়াতে পারলাম সেটিই দেখার চেষ্টা করি। আর এখন কিন্তু লোকাল হয়েই আপনাকে গ্লোবাল ফাইট দিতে হবে। ধরুন কোনো এক ইতালিয়ানকে খুব যত্ন করে পিজা বানিয়ে খাওয়ালেন। উনি হয়তো খুশি হবেন। কিন্তু ঐ ‘ওয়াও’ বলবেন না। অথচ আপনি যদি একটা পাটিসাপটা পিঠা বানিয়ে ওপরে একটু গুড় ছিটিয়ে তার সামনে পরিবেশন করেন। তিনি ওয়াও বলতে পারেন। আমাদের সিনেমাটাও এমন। আমিও তাই পিওর লোকাল হয়ে কাজ করে যেতে চাই। আজীবন বাংলাদেশি পাসপোর্টটাই আমি ক্যারি করি। অনেকেই ভাবেন আমি বেশিরভাগ সময় কলকাতা থাকি। তা কিন্তু না। আমি দেশেই থাকি। এখন একটি কাজে আউটডোরে যেমন যেতে হয়। তেমনি আমিও যাই। কলকাতায় অনেকগুলো কাজ করি। আমার হোটেল স্টে পছন্দ না। তাই একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকি এবং খুবই আইনসম্মতভাবে আমার ওখানকার আয় থেকে আয়কর আমি দিয়ে থাকি। এই ব্যবস্থা করতে আমার অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এবং সবকিছুতে নিয়মমাফিক চলি বলেই আমি খুব স্পষ্ট থাকতে পারি।
শাকিব খান আপনার কলিগ। তিনিও কলকাতার ছবি করেছেন। সফল হয়েছেন। মাঝে বিরতি দিয়ে এবারে প্যান ইন্ডিয়া ছবির কাজ করলেন। বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে শাকিব খানের অবদান নিয়ে কী বলবেন?
প্রথমে শুভ কামনা। আমি মনে করি শাকিবও নিজেকে সময় অনুযায়ী ভাঙছেন। তিনিও সঠিক সুরটি ধরে জীবনের সেরা ছবিটি করে ফেলবেন। অবশ্যই বাণিজ্যিক ছবির প্রয়োজন আছে। আমি যেমনটা ছবি করি।
শেষ প্রশ্ন। এখন অনেকেই নানানভাবে আলোচিত থাকতে চাইছেন। তা নিজের কাজের বাইরে। উন্মুক্ত গণমাধ্যমও তাদের পেছনেই পড়ে থাকছে। এইসব উদ্ভট ভাইরাল প্রবণতা নিয়ে কী বলবেন —
এগুলো থাকবেই। এখন ইন্টারনেটের যুগ। যা খুশি আপনি পোস্ট করে দিতে পারেন। কিন্তু ইতিবাচক অনেককিছু তো ঘটছে। সেগুলো আলোচনায় আনতে হবে বারবার। যেমন ধরুন বুসানে আমাদের ছবি পুরস্কৃত হচ্ছে, নুহাশ খুব দুর্দান্ত কাজ করছে, ফেস্টিভ্যালগুলোতে বাংলা ছবি দারুণ সমাদৃত হচ্ছে। আসলে এগুলোকে আমি দেখি বুফে মেন্যুর মতো। প্ল্যাটারে বিভিন্ন ধরনের খাবার থাকবে আপনাকে বেছে নিতে হবে এবং আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিও তাই …যত ভালো ভালো কন্টেন্ট দেবেন, তত এসব অনুল্লেখ্য বিষয়গুলোর চর্চা কমে যেতে থাকবে।