গত ৩ ডিসেম্বর একজন বেপরোয়া প্রাইভেট কারচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেলের চালক ও তার পেছনে বসা নারী যাত্রী উভয়েই ছিটকে মাটিতে পড়ে যান। নারী যাত্রীর ওপর দিয়ে কারটি চলে যাওয়ার সময় তার পরিধেয় কাপড় বা শাড়ির অংশ বাম্পারে পেঁচিয়ে গেলে তিনি দুর্ভাগ্যবশত গাড়ির বাঁ দিকের বাইরে দুই চাকার মধ্যে আটকে যান। এমতাবস্থায় গাড়ির চালক দ্রুতগতিতে গাড়ি নিয়ে পালাতে থাকেন। এভাবে নারী যাত্রীকে রাস্তায় ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে এফ রহমান হলের দিকে এক মাইল রাস্তা পার হয়ে যান। এই দৃশ্য দেখে ঐ গাড়িচালককে থামানোর জন্য পেছনে কয়েকটি মোটরসাইকেল, পথচারীরা দৃষ্টি আকর্ষণ করে থামানোর চেষ্টা করতে থাকলে গাড়িচালক আরো দ্রুত বেগে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে একসময় নীলক্ষেত চৌরাস্তার মোড়ে আটকা পড়েন। ক্ষিপ্ত জনতা তাকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের মাধ্যমে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। গুরুতর আহত সেই নারীকে বাঁচানো যায়নি।
এমন দৃশ্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সব গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যারা টিভিতে এই ভিডিও দৃশ্য দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা জাতির বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। কমপক্ষে ১০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে যে, কার চালক বেপরোয়াভাবে গাড়িটিকে চালিয়ে না নিয়ে গেলে হয়তো নারীটিকে বাঁচানো যেত। আরো নানা প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে এই নির্মম ঘটনায়। চালক কেন এত বেপরোয়া ভাব প্রদর্শন করেছেন? তার কারণটা আসলে কী ছিল? গাড়ি চালকের পেছনে মোবাইল ফোনের ভিডিও চালু করা অবস্থায় একটি মোটরবাইককে অনুসরণ করতে দেখা যায়। সেই বাইকে দুজন ছিল। তারা বেপরোয়া কারটি থামানোর জন্য অনবরত চিৎকার করে পিছু ছুটছিলেন। কিন্তু কারচালক এতে আরো বেশি দ্রুত পালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তার এই পালানোর প্রবণতা গাড়ির নিচে আটকে যাওয়া নারীটির করুণ পরিণতি ডেকে আনে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, দুর্ঘটনাকারী কারের চালক বেশি ভয় পেয়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। ভয়টা তার নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছিল। এই ঘটনাকে ঘিরে নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।
আসলে আমাদের দেশে সড়কপথ মানেই যেন ভয়ের জায়গা। এখানে সড়কে চলতে গেলেই নানা ভয় সবার মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। এই ভয় শুধু যাত্রীর নয়। এই ভয় পথচারীর ভয়। এই ভয় গাড়ির মালিকের ভয়, এই ভয় গাড়িচালকের ভয়, পথের ধারে যারা বাস করে, দোকান করে, ব্যবসা করে—সবার ভয়। এই ভয় থেকে নানা বেদনার সৃষ্টি হয়, হয় নানা করুণ কাহিনী উপাখ্যান। এই ভয়, কষ্ট ও বেদনার শেষ কোথায়? তা কেউ জানে না।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় স্বামীহারা মরহুমা রুবিনার জীবনাবসান হয়েছে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। তার স্বজনেরা এটাকে মৃত্যু না বলে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিচার দাবি করেছেন। তার স্কুলপড়ুয়া ছেলেটিকে এখন থেকে কে দেখভাল করবে বলে তার বোনেরা হতাশা ব্যক্ত করছেন ইতিমধ্যে। কিন্তু এমন বিচারের দাবি কার মাধ্যমে কোথায় গিয়ে নিশ্চয়তার বাস্তবতা খুঁজে পাবে, তা কেউ হয়তো জানেন না।
প্রতিদিন ঘটছে এমন অনেক ঘটনা। শুধু প্রতিদিন নয়, প্রতি ঘণ্টায় এমন নিষ্ঠুর ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে বহু মূল্যবান প্রাণ। পঙ্গু করে দিচ্ছে অনেক সম্ভাবনাময় জীবনকে। অনেক আশাবাদী পরিবারের সব আশা ভরসাকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। একই দিনে যশোরের মনিরামপুরের বেগারীতলা বাজারে একটি কাবাবের দোকানে কাভার্ড ভ্যান ঢুকে বাবা-ছেলেসহ পাঁচ জনের করুণ মৃত্যু ঘটেছে। হোটেলটি তছনছ হয়ে গেছে।
সেখানেও একই দৃশ্য দেখা গেছে। কাভার্ড ভ্যান ফেলে সেটার চালক ও হেলপার উভয়ে পালিয়ে গেছে। এই পালানোর প্রবণতা আমদের দেশে একটি অনৈতিক অনুশীলন। কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সবার আগে চালক ও হেলপার লাপাত্তা হওয়ার প্রবণতা আমাদের জাতিগত দুর্বলতা। এই পলায়নকর প্রবৃত্তি ও চৌর্যবৃত্তির দুর্বলতা আমাদের সব পরিবহন সেক্টরের হীনতাকে আরো নগ্নভাবে প্রকাশ করে চলেছে।
এর মাধ্যমে নিজে দোষ করে অপরের ঘাড়ে চাপানোর মানসিকতা প্রকট হচ্ছে। এটাই জাতির প্রতিটি মানুষকে শেখানো হচ্ছে। এই হীনমানসিকতার পরিবর্তন নিয়ে কখনো চিন্তাও করি না। কারণ আমাদের দেশে মানুষের প্রতি মানুষের যেন দরদ নেই। শ্রদ্ধা-ভক্তি নেই। মানুষের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন ছাড়া সামাজিক উন্নতি লাভ করা অসম্ভব। এসব কথা এখনো কথার কথা হিসেবে প্রচলিত থেকে গেছে। এগুলোর বাস্তব ভিত্তি উধাও হয়ে গেছে আমাদের নীতিহীনতার কারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়িচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সাবেক শিক্ষক। তিনি মোটরবাইকটিকে ধাক্কা দিয়ে দুই যাত্রীকে আহত করার পর একবারের জন্যও ভাবলেন না, একবার নিজে গাড়ি থেকে নেমে আহতদেরকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি! যদি এই মানসিকতা থাকত, তাহলে এত বড় করুণ ঘটনার জন্ম নিত না। এই মানসিকতার জন্ম না হওয়ার পেছনে সরকারি নীতিহীনতাকে দায়ী করা যায়। যেমন : এখনো আমাদের সিংহভাগ গাড়িগুলো ইনসিওরেন্সবিহীনভাবে রাস্তায় চলাচল করার অনুমতি পায়। সেজন্য তারা নির্দ্বিধায় চলাচলের সাহস করে। এখনো যান্ত্রিকভাবে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় না। সামান্য উপরি দিলেই অচল গাড়ি ফিটনেস সার্টিফিকেট পেয়ে রাস্তায় দৌড়াতে শুরু করে। গাড়িচালকের কোনো সাইকোলজিক্যাল টেস্ট ব্যতিরেকে লাইসেন্স হাতে তুলে দেওয়া হয়।
বিশেষ করে, ইনসিওরেন্সের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে দুর্ঘটনার জন্য যথার্থভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া-নেওয়ার সিস্টেম চালু না থাকায় মালিক, চালক, যাত্রী পথচারী—সবাই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন যদি হতো যে, কেউ কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হলে তার জন্য ভয়ের কারণ নেই। তার সব ধরনের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে ইনসিওরেন্স করা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান প্রতিটি দুর্ঘটনার কারণ ও বাস্তব দিকগুলো যাচাই করে অতি দ্রুত দায়ী চিহ্নিত করবে এবং যে পক্ষ দুর্ঘটনার জন্য যতটুকু দায়ী সাব্যস্ত হবে সে পক্ষ ততটুকু ক্ষতিপূরণ পাবে বা প্রদান করবে। তাহলে তা কতই-না ভালো হতো!
আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালকের দ্রুত লাপাত্তা হওয়ার কারণ হলো গণপিটুনিতে তার নিজের জীবন হারানোর ভয়। গাড়ি ধ্বংস হোক, কিন্তু নিজের জীবন বাঁচলে মালিক আমাকে আরেকটা গাড়ি কিনে দেবে। কারণ মালিকের অঢেল টাকা আছে। কারণ জনতা নিজের হাতে আইন তুলে নেয়। জনতা মনে করে, পুলিশি মামলা হলে নানা জটিলতা ও হয়রানিতে পড়ে এর সুষ্ঠু বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা হবে। তাই শাস্তিটা আমরা নিজেরাই দিয়ে নিই। আমাদের দেশে উচ্ছৃঙ্খল জনতার এরূপ আচরণ ও হীনমানসিকতা বেশ ক্ষতিকর।
উন্নত বিশ্বে কোথাও কোনো পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটলে সেজন্য সরকারি কর্তৃপক্ষকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না। এজন্য প্রতিটি যানবাহনের মালিককে দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে করা নির্দিষ্ট ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলো সার্বিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তাই তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। যেহেতু সব পক্ষের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যাপারে নিরাপত্তাবোধ থাকে, সেহেতু কেউ হতাশ হয়ে গাড়ি চালায় না। কেউ গাড়ি চালাতে গিয়ে ভয় পায় না। এমনকি গাড়ি চালাতে গিয়ে কেউ কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হলে পালাতে চেষ্টা করে না। দুর্ঘটনা ঘটিয়ে কাউকে লাপাত্তা হওয়ার রেকর্ড নেই সেসব দেশে।
বরং কারো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে তিনি দ্রুত জরুরি নম্বরে নিকটস্থ হাসপাতাল বা পুলিশ স্টেশনে জানিয়ে দেন এবং তার এনআইডি ও ইনসিওরেন্স কোম্পানির তথ্য পাঠিয়ে দেন। এমনকি কারো কর্মস্থলে যাওয়ার পথে যদি পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে তার কাছ থেকে দ্রুত আইডি নম্বর নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এজন্য তার সময় নষ্ট করা হয় না বা কাজে কোনো ব্যাঘাত দেওয়া হয় না। তাদের সব তদন্ত হয় নির্ভেজাল বা দুর্নীতিমুক্ত। তদন্তের পর যার যেমন দায় খুঁজে পাওয়া হয়, তার তেমন সাজা বা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এমনকি সিগন্যাল অমান্যকারীকেও সিসি ক্যামেরার রেকর্ড দেখে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। এজন্য কাউকে সরাসরি কোনো থানা অফিস বা হাজতখানায় আসতে হয় না। বরং পরে তদন্ত করে অফিসের বেতন বা তার ব্যবসার ব্যাংক হিসেব থেকে জরিমানা কর্তন করে বাড়িতে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
জাপানে কোনো গাড়িচালক যদি পথচারী বা রাস্তার কোনো লাইটপোস্টকে ধাক্কা দেয়, তাহলে তার জন্য শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ অনেক বেশি। কারণ, ধরে নেওয়া হয় চালক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গাড়ি চালিয়েছেন। এই ধরনের আইনের কঠোরতায় সেখানে মাতাল হয়ে কেউ গাড়ি চালায় না। অথচ আমাদের দেশে চালকরা কেউ মাদক গ্রহণ করলেও সেটা নিরূপণের ব্যবস্থা নেই, সড়ক আইনের কঠোরতাও নেই। উদাসীনতা ও দুর্নীতির বেড়াজালে নিসচারের দেওয়া ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও ফাইলবন্দি হয়ে আছে। সড়কে দিন দিন বর্ধিত নিরাপত্তাহীনতায় নানা ভয় ও আশঙ্কা যুক্ত হচ্ছে। এসব ভয় ও বেদনার শেষ কোথায়?
আমরা সবকিছু ডিজিটালাইজড করার চেষ্টা করছি, কিন্তু এখনো রাস্তার জরুরি অটোসিগন্যাল বাতিকে বাস্তবে কার্যকরী করতে পারিনি। আধুনিক যুগে বাস করে এখনো মানুষের অঙ্গুলিহেলানে রাস্তায় গাড়ি চালানো হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন জনভোগান্তি সৃষ্টিকারী নীতির বাস্তবায়ন চলতে থাকলে দুর্ঘটনাকারী চালকরা জনরোষের ভয়ে গাড়িসহ লাপাত্তা হওয়ার চেষ্টা করতেই থাকবে। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষকের মতো গাড়িচালকরাও মানুষের প্রতি দরদ ভুলে জীবনের ভয়ে পালাতে গিয়ে বড় ভুল করে বসছেন। এজন্য প্রত্যেক গাড়ির ইনসিওরেন্স নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের প্রত্যেককে নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। গাড়িচালক, যাত্রী, পথচারী সবাইকেই সচেতন হতে হবে। যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়া যাবে না। অবৈধভাবে গাড়ি ওভারটেক করা যাবে না। ট্রাফিক আইনের ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। তাহলেই সড়ক হবে নিরাপদ। সড়কে নেমে সবার ভয়ভীতি দূর হবে।