নববর্ষের আগের দিন তথা ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর রুশ সেনাদের লক্ষ্য করে তীব্র হামলা চালায় ইউক্রেনীয় বাহিনী। দিনটিতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন মাস কয়েক আগে ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্ত হওয়া রুশ সেনারা। রাশিয়া অধিকৃত দোনেস্ক অঞ্চলের মাকিভকা শহরের একটি ভোকেশনাল স্কুলে স্থাপিত যে অস্থায়ী ব্যারাকে অবস্থান করছিলেন সেনারা, তার পাশেই ছিল প্রকাণ্ড গোলাবারুদের ডিপো। বিশ্রামরত সেনারা যখন স্ত্রী-পরিবারকে ফোন দিতে নিজেদের সেলফোন চালু করেন, ঠিক তখনই ব্যারাকে আছড়ে পড়ে গোলাবারুদ! কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে ওঠে ইউক্রেনকে সরবরাহ করা অত্যাধুনিক মার্কিন হিমারস রকেট। চোখের নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যায় স্কুল বিল্ডিং ও সেনা ব্যারাক। বাতাসে তীব্র হতে থাকে গোলাবারুদের উৎকট গন্ধ।
চোখে পড়ার মতো বিষয়, যখনই এভাবে রাশিয়ান বাহিনীর ওপর বিপরীত পক্ষ থেকে হামলার ঘটনা ঘটেছে, ইউক্রেনীয় সেনাদের নৈপুণ্যে রুশ বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়েছে, রাশিয়া তাকে ব্যাখ্যা করেছে ‘ভিন্নভাবে’! ব্যতিক্রম ঘটেনি এই হামলার ক্ষেত্রেও। হামলার পর রাশিয়ার তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বলা হয়, রাশিয়ান সেনাদের ভুলেই এই হামলা ও হাতাহত। কী অদ্ভুত কথা!
উল্লেখ করতে হয়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর ওপর চালানো প্রায় প্রতিটি হামলার পর আবোলতাবোল সব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পুতিন নিযুক্ত মুখপাত্ররা। এমনকি রাশিয়ান বাহিনীর ওপর চালানো সবচেয়ে মারাত্মক হামলার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও ‘অবান্তর’ সব কথা বলছে রুশ কর্তৃপক্ষ। এর আগে রুশ সমুদ্র জাহাজে আক্রমণ চালানোর ঘটনা ঘটলে ‘জাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে দুর্ঘটনার সূত্রপাত’—এই ব্যাখ্যা হাজির করেছিল কর্তৃপক্ষ। নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করার কী সুনিপুণ চতুরতা!
নিজের সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সেনাদের সেলফোন ব্যবহারের কারণেই এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। রাশিয়ান সেনাদেরকে ব্যক্তিগত সেলফোন ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, তাদের সংকেতগুলো জিওলোকেটেড করা আছে। এই অবস্থায় ছুটির দিনে বাড়িতে কথা বলার জন্য যেই না সেনারা সেলফোন চালু করেছেন, অমনি টেকনোলজির সুযোগ লুফে নিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে ইউক্রেনের সেনারা। যদিও এ ধরনের ব্যাখ্যা ও আক্রমণের বিবরণ সন্তুষ্ট করতে পারেনি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের। এই ঘটনা তো বটেই, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন অবধি প্রতিটি হামলার পর কর্তৃপক্ষের হাজির করা ব্যাখ্যা ও যুক্তি তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ে চলেছে রাশিয়া জুড়ে।
সত্যিকার অর্থেই, পুতিনের বাছাই করা কর্তাব্যক্তিরা যে দোষারোপের খেলা শুরু করেছেন, তা নিয়ে রাশিয়ানদের মধ্যে দানা বাঁধা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। হতাহতের সংখ্যা নিয়ে যে ছলচাতুরী খেলা খেলছেন পুতিন, তা বেশ বিব্রত করছে রাশিয়ার জনগণকে। উক্ত হামলার ঘটনার পর ৬৩ রুশ সেনা নিহত হয়েছে বলে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে দাবি করেছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, এই সংখ্যা আরো বেশি—অন্ততপক্ষে ৯০। অন্যদিকে, হামলার পর ইউক্রেন দাবি করে, প্রায় ৪০০ সেনাকে ঘায়েল করেছে সাহসী ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা! প্রকৃত ঘটনা যা-ই হোক, রাশিয়ার দাবিকে সমর্থন করতে নারাজ খোদ রাশিয়ান ব্লগাররাই। ইউক্রেনীয় সেনাদের হাতে রুশ সেনাদের প্রাণ হারানোর ঘটনা নিয়ে যে তথ্য উপস্থাপন করে পুতিন বাহিনী কিংবা তার মনোনীত ব্যক্তিবর্গ, তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন রাশিয়ান বেসামরিক নাগরিকরা। তারা অনুমান করেন, শত শত রুশ সেনা প্রাণ হারাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে, যা গোপন করে যাচ্ছে রুশ কর্তৃপক্ষ। এ ধরনের বিশ্বাস এখন প্রায় প্রতি জনের মধ্যেই। সম্প্রতি পুতিনের কাছ থেকে পদক পাওয়া ব্লগার সেমিয়ন পেগভও আছেন এই দলে! সেলফোন-সম্পর্কিত দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন অনলাইন প্ল্যাটফরম ‘ওয়ার গনজো’-এর পরিচালক সেমিয়ন। পালটা তিনি দাবি তুলেছেন, ‘এটা রুশ বাহিনীর অজুহাত ও দোষারোপের নির্লজ্জ চেষ্টা’!
একই ধরনের যুক্তি অন্য একটি ব্লগ ‘গ্রে জোন’-এরও। সেলফোনের ব্যাখ্যাটিকে ‘৯৯ শতাংশ মিথ্যা’ দাবি করে একে ‘দায়িত্ব এড়ানোর বৃথা চেষ্টা’ বলে অভিহিত করে ব্লগটি। উপরন্তু একে ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ রকম বিভিন্ন দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন রাশিয়ান আইনপ্রণেতাদের একটি দলও। ‘একটি অরক্ষিত বিল্ডিংয়ে অস্থায়ীভাবে এত বিপুলসংখ্যক সেনাকে কেন, কী উদ্দেশ্যে জড়ো করা হয়েছে’—এমন দাবি তুলে বিষয়টি নিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছে এই মহল। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সের্গেই মিরোনভ বলেছেন, যে বা যারা এমন বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘ব্যক্তিগত অপরাধমূলক দায়’ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যুদ্ধের প্রতি সামরিক বাহিনীর শিথিল দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন রাশিয়ার অত্যন্ত প্রতাপশালী নেতা মিরোনভ।
মিরনভের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করে রুশ কট্টরপন্থিরা দাবি করেন, গত সেপ্টেম্বরে যে উদ্দেশ্যে পুতিন নতুন করে ৩ লাখ সেনা ইউক্রেন যুদ্ধে সংযুক্ত করেন, তা কোনো ফলই বয়ে আনেনি। বরং একের পর এক ঝরছে রুশ সেনার প্রাণ। মজার ব্যাপার হলো, অন্তত এখন পর্যন্ত কেউ প্রকাশ্যে পুতিনের দিকে সরাসরি আঙুল না তুললেও রাগ-ক্ষোভে ফুঁসছেন অনেকেই। বিরতিহীনভাবে রুশ সেনাদের মুখ থুবড়ে পড়ার ঘটনায় ‘অশনিসংকেত’ দেখছেন পুতিনের নিজের ঘরের লোকজনই। যেমন—রাষ্ট্রচালিত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক আরটি-এর প্রধান সম্পাদক মার্গারিটা সিমোনিয়ান বলেছেন, ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি সমাধানের রাস্তা হতে পারে না মোটেও। এতে কেবল জন-অসন্তোষ বাড়বেই।’
উল্লেখ করার মতো বিষয়, মাকিভকা শহরে নিহত সেনাদের অনেকেই দক্ষিণ-পশ্চিম রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরবর্তী সামারা শহর থেকে এসেছিলেন ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিতে। ইউক্রেনকে গুঁড়িয়ে দিতে এসে পালটা নিজেরাই বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত প্রিয়জনদের জন্য শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন নিহতদের পরিবারবর্গ। নিহত সেনাদের শ্রদ্ধা জানাতে রুশ পাবলিক মেমোরিয়াল সার্ভিসে জড়ো হন হাজারো মানুষ। তাদের মধ্যে যতটা না শোক দেখা গেছে, তার চেয়ে বেশি দেখা গেছে ক্ষোভ, অভিমান! যাহোক, শেষ পর্যন্ত রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকারোক্তি দেয় যে, আক্রমণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেনা নিহত হয়েছে। এরপর সামরিক ব্লগাররা জড়িয়ে পড়েন তীব্র বিতর্কে—পুতিনের পক্ষে-বিপক্ষে চলে তর্ক, যুক্তি। এই অবস্থায় মাকিভকার ঘটনাকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেয় ক্রেমলিন। এর পরের দৃশ্যে কী ঘটেছে, তা সবারই জানা। চরম আগ্রাসি হয়ে ওঠে পুতিন বাহিনী। ইউক্রেনের বেসামরিক অবকাঠামো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে রুশ সেনারা।
এখন প্রশ্ন হলো, রাশিয়ান বাহিনীর এই ‘অতি তৎপরতা’ কি পুতিনের ব্যর্থতাকে ঢাকতে পারবে? ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের হাতে করুণ পরিণতি বরণ করার পর একটা করে ‘খোঁড়া যুক্তি’ সামনে এনে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে পারবে পুতিন বাহিনী? মনে রাখতে হবে, এখন পর্যন্ত প্রতিটি দায়মুক্তির ঘটনায় ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’কে বাদ দিয়ে ‘অভিযোগের তির’ ছোড়া হয়েছে সামরিক অফিসারদের দিকে। শীর্ষ নেতৃত্বকে আগলে রেখে ধারাবাহিকভাবে আঙুল তোলা হয়েছে সম্মুখসারির যোদ্ধাদের দিকেই। মাকিভকার হামলা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট পুতিন কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য করেননি বটে, কিন্তু এভাবে কতদিন তিনি মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে পারবেন? কতদিনই-বা বন্ধ করে রাখতে পারবেন জনগণের মুখ?