প্রিয় পাঠক আপনারা আমার সাথে একমত হতে পারেন আবার নাও হতে পারেন। সেই স্বাধীনতা আপনাদের আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘুষ-দুর্নীতি ও লুটপাটের যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা কল্পনাকেও যেন হার মানাচ্ছে। এসব অপকর্ম রাষ্ট্র ও সরকারের উচ্চপর্যায় যেমন- এমপি, সেনাপ্রধান, পুলিশ প্রধান, ঠিকাদার, রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা, ব্যাংকের পরিচালকরা যেমন রয়েছেন তেমনি ড্রাইভার, পিয়ন ও কেরানিও কম যায়নি। এদের মধ্যে কেউ কেউ সাবেক আবার কেউ কেউ বর্তমানের। ঘুষ, দুর্নীতি, টাকা পাচার আমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর বিপদ। ঘুষ, দুর্নীতি, টাকা পাচার ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা মহামারির আকার ধারণ করার আগেই প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। এই ঘুষ, দুর্নীতি, টাকা পাচার আমাদের উন্নয়ন, গতিশীল সামাজিক বৈষম্য এবং বিশৃঙ্খলার প্রধানতম কারণ। ঘুষ সচল থাকার কারণে দুর্নীতি সচল আছে, আর দুর্নীতি সচল থাকার কারণে টাকার পচারের গতিও সচল। এগুলো পারিবারিক সংকট তৈরি করছে, আমাদের সমাজকে ধ্বংস করছে, ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করছে, এবং উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষকে চরম আত্মকেন্দ্রিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এবং যখন মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারীরা আত্মতৃপ্তি লাভ করে । ‘ঘুষ ছাড়া সেবা নেই।’ দেশের প্রায় ৭১ শতাংশ পরিবারকে ঘুষ দিয়ে সরকারের বিভিন্ন খাত থেকে সেবা নিতে হয়। ঘুষ বাণিজ্য আজ ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। ঘুষের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট, দুরবস্তা, অপরাধ প্রবণতা, সামাজিক- অর্থনৈতিক বৈষম্য ও উগ্রতা। ঘুষের কারণেই দেশের দ্রব্যমূল্যের দাম হুহু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর নাগাল টেনে ধরা যাচ্ছে না। নড়বড়ে হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক ভীত, সামাজিক ও জাতীয় উন্নয়ন কাঠামো, ব্যাহত হচ্ছে সরকারে পরিকল্পনা, বাধাগ্রস্ত রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রক্রিয়া। ঘুষ-দুর্নীতি মানুষের মেধাশক্তি এবং মানবিক গুণাবলির বিকাশ ধ্বংস করে দেয়। ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে বিশৃঙ্খলা, হত্যা, আত্মহত্যা, খুন, ধর্ষণ, বিবাহ বিচ্ছেদ, অপসংস্কৃতি, অপকৌশল, হিংসা, বিদ্বেষ, উন্মাদনা সাম্প্রদায়িতকতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো। যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
তাই আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং একত্রিত হয়ে এসব সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। নিজেদের মাননসিক সংস্কারও জররী। দুর্নীতি আমাদের সমাজের ভিত্তি ভেঙে দেয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং মানুষের বিশ্বাসকে নষ্ট করে। যখন জাতি এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করে, তখনই আমরা সত্যিকার উন্নতি সাধন করতে পারব। এগুলো শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, বরং আমাদের সমাজ ও দেশের ভবিষ্যতকেও বিপন্ন করে। যখন জনগণ ন্যায় ও স্বচ্ছতার অভাব অনুভব করে, তখন তারা সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় এবং সঠিক উন্নয়ন সম্ভব হয় না। ঘুষ, দুর্নীতি ও টাকা পাচার আমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর বিপদ, কারণ এগুলো দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে। যখন সৎ লোকেরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং অসৎ লোকেরা পুরস্কৃত হয়, তখন সমাজে ন্যায়বিচার ও আস্থার অভাব দেখা দেয়। দুর্নীতি আমাদের সমাজের মূলভিত্তিকে দুর্বল করে, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়, যা দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে এ সংকট থেকে মুক্তির জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে এবং পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। দুর্নীতি আমাদের সমাজের ভিত্তিকে নষ্ট করে, সৎ মানুষের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে এবং দেশকে দুর্বল করে তোলে। এই সমস্যাগুলোর কারণে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং উন্নয়ন থমকে যায়।
ঘুষের কারণেই দুর্নীতি করা সহজ হচ্ছে, সহজেই ঘুষ দিয়ে দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়া যাচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জরিপে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলো যথাক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ, পাসপোর্ট ৬৭ দশমিক ৩, বিআরটিএ ৬৫ দশমিক ৪, বিচারিক সেবা ৬০ দশমিক ৫, ভূমি সেবা ৪৪ দশমিক ৯, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) ৪২ দশমিক ৯ এবং স্বাস্থ্য (৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ঘুষের শিকার হয়েছে। এছাড়াও আছে গ্যাস, স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ইত্যাদি। দেশে ১ হাজারেরও বেশি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের প্রতিটিতে দৈনিক গড়ে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় হয় বলে জানিয়েছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দেশের ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতের ওপরে জরিপ করে দুর্নীতি ও ঘুষের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রশাসন, ভূমি, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা, গ্যাস সেবা খাতে এই জরিপ করে টিআইবি। চাকরিতে ঘুষের বাজার ৫ হাজার কোটির টাকার উপরে। দেশে ব্যক্তিমালিকানার বাস-মিনিবাসের সনদ ইস্যু ও নবায়নে বাসপ্রতি গড়ে ১৭ হাজার ৬১৯ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ খাত থেকে বছরে ঘুষ ও চাঁদাবাজি হয় অন্তত ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকার। ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর ঘুষ লেনদেন হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। অংশগ্রহণকারীরা ১৭টি সেবার কোন খাতে কে কী পরিমাণ দিয়েছেন তা বর্ণনা করেছেন। এতে দেখা যায়, ওই সময়কালে ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এর পরিমান কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঘুষ, দুর্নীতি ও টাকা পাচারের ফলে সমাজে কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়, আবার কেউ কলাগাছ থেকে শুকিয়ে আঙুলের মতো হচ্ছে। ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী; দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বেড়েছে; ৯) বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়া বাড়ছে; প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে এবং দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাজেটের টাকা শীর্ষ ধনীদের অ্যাকাউন্টে চলে যাওয়ার সুব্যবস্থা আছে বলেই ঋণখেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিদেশে টাকা পাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে শিল্পায়ন বা কর্মসংস্থান আর কোনোটাই হয়ে ওঠে না এই দেশে। সোনালী, রূপালী, জনতা ব্যাংকের ৮৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ মানে দেশের বাজেটের ৯ ভাগের ১ ভাগ! এই টাকা নেওয়া হয়েছে শিল্পায়নের নামে। অথচ এই টাকায় উৎপাদন হয়নি, শিল্পায়ন হয়নি, গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্ম সৃষ্টি হয়নি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশও হয়নি। পাটশিল্প, কাগজশিল্প, তাঁতশিল্প, চিনিশিল্প ধুঁকছে; অথচ শিল্পায়নের নামে লুটপাট হয়ে গেছে জনগণের লাখো কোটি টাকা। জনগণের করের টাকায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। অথচ অর্ধেক সক্ষমতাই অকেজো বসে থাকে। (এর মধ্যে আদানিকেই বসিয়ে বসিয়ে ‘ভাড়া’ দিতে হয় বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। ১৪ বছরে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা!)
ঘুষ, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ এবং টাকা পাচার ঐখানেই লেখা আছে তোমার আমার দেশের সর্বনাশ। ঘুষ, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ এবং টাকা পাচার প্রতিরোধে শক্তিশালী আইন প্রণয়ন এবং তার কার্যকরী প্রয়োগ অপরিহার্য এবং সেইসাথে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং তার অর্জিত সম্পদ জব্ধ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগাড়ে জমা করতে হবে। সেই সঙ্গে এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদেরও একই আইনের আওতায় নিয়ে এসে তাদেরও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজন প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারীদেরকে সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে বয়কট করতে হবে, সম্ভব হলে পাড়া-মহল্লার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারীদের ছবিসহ নামের তালিকা সাঁটিয়ে দিতে হবে,যাতে প্রতিটি মানুষ এদেরকে চিনতে পারে এবং ঘৃণাভরে প্রত্যখান করতে পারে। ট্যাগ লাগানোর সংস্কৃতি থেকে বেড়ি আসতে হবে। একজন অপরাধীর পরিচয় হবে অপরাধী হিসেবে আর সে কোন মহলের এটা কোন বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও গতিশীল অর্থনীতির বাংলাদেশ গড়তে দেশের প্রতিটি সেক্টরকে আন্তরিক হতে হবে এবং দেশেপ্রেমের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আমরা আমাদের দেশটাকে ঘুষ, দুর্নীতি ও টাকা পাচারমুক্ত দেশ হিসেবে দেখতে চাই। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ এবং টাকাপাচাকারীদের শাস্তি প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের দূর্ভাগ্য এখানো পর্যন্ত কোন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ এবং টাকা পাচারকারীদের কোন দৃষ্টান্তশূলক শাস্তি হতে দেখিনি। সরকারের পাশাপাশি যদি আমরা সচেতন ভাবে এগিয়ে আসি তাহলেই হয়তো সম্ভব হবে। আমরা যদি ঘুষ, দুর্নীতি এবং টাকা পাচার রোধ করতে পারি তবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, প্রিয় বাংলাদেশ পরিণত হতে পারবে এবং এতে সন্দেহর কোন অবকাশ থাকার সুযোগ নেই।