স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম উপকরণ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ওষুধশিল্প কেন্দ্রীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হাতেগোনা কয়েকটি ওষুধ উত্পাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে ওষুধশিল্প সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিকশিত হতে শুরু করে। ১৯৮২ সালের ড্রাগ অর্ডিন্যান্স জারি হওয়ার পর থেকে প্রথম বারের মতো ওষুধ বা ফার্মাসিউটিক্যালসকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মূলত তখন থেকেই এই শিল্পের বিকাশ হতে শুরু করে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এ শিল্পে ব্যাপক প্রসার ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টিরও বেশি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪টি কারখানা নিয়মিতভাবে ওষুধ উৎপাদন করে যাচ্ছে। এসব কারখানায় প্রায় ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ উৎপাদন করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় সব ধরনের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। আর এসব উৎপাদিত ওষুধপণ্য বিশ্বের প্রায় ১৬০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ওষুধশিল্পে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
ওষুধশিল্প খাতে বেশ কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। বাংলাদেশে ওষুধশিল্প প্রসারে প্রধান অন্তরায় হলো জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ। বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি সমস্যার সমাধান হলে এ শিল্পের প্রসার ও সম্ভাবনা খুব দ্রুত ঘটবে। পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবের ফলে এ শিল্পের প্রসার ব্যাহত হচ্ছে। যে কোনো শিল্প প্রসারের ক্ষেত্রে গবেষণা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো প্রতি বছর গড়ে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার গবেষণা খাতে খরচ করে থাকে। যেসব দেশের গবেষণা যত উন্নত, সেসব দেশে শিল্পের প্রসার তত বেশি। তাই শিল্পকে এগিয়ে নিতে গবেষণার পরিধি আরো বাড়াতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত সরকারি মান যাচাইকারী কোনো ল্যাবরেটরি নেই। এর ফলে দেশের ওষুধ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও, ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সে স্বীকৃতি অর্জন করতে সমর্থ হয়নি। তাই যত দ্রুত সম্ভব, সরকারি মান যাচাইকারী ল্যাবরেটরি স্থাপন করা। এছাড়া বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু আইনি ও নীতিগত বাধা আছে। সেসব বাধা দূর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে কর্মকাণ্ড বাড়ানোর দরকার আছে বইকি। আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। এ শিল্পের প্রসারের জন্য দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা ব্যাপক। যদিও এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প খাতে মেধাবী ও কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন একটি বিশাল মানবসম্পদ রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সুযোগের অভাবে সেই সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
উপযুক্ত সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণে সবচেয়ে কার্যকরী অবদান রাখতে পারে সরকার। আর এর জন্য ওষুধশিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে সরকারকে মেগা প্রজেক্ট ও বিশেষ উদ্যোগ হাতে নিতে হবে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে দেশে অনেক বিনিয়োগকারী আছে, তারা যদি এই শিল্প খাতে বিনিয়োগ করে, তাহলে এই খাত বহুদূর এগিয়ে যাবে।
বর্তমানে বিশ্বে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওষুধের বাজার রয়েছে। ভারত ও চীনের পাশাপাশি বাংলাদেশও এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন ওষুধশিল্প খাতকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া।