টানা পাঁচ দিনের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের ৯ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেসব এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য ও খাবার পানির সংকট। চলাচলের রাস্তা পানিতে ডুবে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্যা দুর্গতদের। সোমবার বিকালে দেয়াল, পাহাড়ের মাটি চাপা ও পানিতে ডুবে চার শিশুসহ ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও ফুলেশ্বরী নদীর বাঁধ ভেঙে পানিতে ডুবে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রাথমিক হিসাবে ৫১ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক এবং আড়াই কিলোমিটার মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। দুর্গতদের মধ্যে ইতিমধ্যে ৫৮ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে জেলা প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল থেকে ভারী বর্ষণে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় কক্সবাজার-চট্টগ্রাম যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। দোহাজারী হাইওয়ে থানার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের হাশিমপুর কসাইপাড়া,পাঠানীপুল, দোহাজারী পৌরসভার কলঘরব্রীজ এলাকায় রাস্তার উপর প্রায় আড়াইফুট এবং সাতকানিয়ার কেউচিয়ার নয়াখাল, নতুন রেললাইন, কেরানীহাটবাজার এবং ছদাহার হাসমতের দোকান এলাকায় মহাসড়কের ওপর দিয়ে একফুটের বেশি পানি উজান থেকে ভাটির দিকে প্রবাহিত হলে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। কিছু বড় যান ধীরগতিতে চললেও ছোট ও মাঝারি যান চলাচল বন্ধ থাকে। এর আগে সোমবার থেকে বান্দরবান সড়কের বাজালিয়া এলাকায় পানি উঠে কক্সবাজার-চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়।
এদিকে সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। মেরিন ড্রাইভের কিছু অংশে জিওব্যাগে বালির বাঁধ তৈরি করে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হলেও নতুন করে আরও কয়েকটি স্পটে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার রাতে মুষলধার বৃষ্টিতে শহরের পর্যটন জোনের প্রধান ও উপসড়কে এক-দেড়ফুট পানি প্রবাহিত হয়। নিচু লেভেলে থাকা অনেক হোটেলের নীচতলায় পানি ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি হয়। সৈতকপাড়ায় অনেক বাসাবাড়িতেও পানি ঢুকেছে পড়েছে বলে জানা গেছে।
দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন মোতায়েন
ভারী বর্ষণের ফলে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলায় চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল কার্যক্রম শুরু করেছে। ১০ পদাতিক ডিভিশন কর্তৃক কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহ ও বিভিন্ন তথ্যের জন্য রামু সেনানিবাসে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার ১২টা থেকে রাত ১২ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৯৩ মিলিমিটার। আরও কয়েকদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে।
চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, পাহাড়ি ঢল এবং জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি। ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে কাকরা, লক্ষ্যরচর, বুমুবিল ছড়ি, সুরেজপুর-মানিকপুর, কৈয়ারবিল, কোনাখালী ইউনিয়ন। মাতামুহুরীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়েছে। বৃষ্টি না থামলে ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা রয়েছে।
জেলা পরিষদ সদস্য মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ফুলেশ্বরী নদীর বাঁধ ভেঙে ঈদগাঁও উপজেলার কয়েকটি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে জনসাধারণ। কৃষিজমিসহ তলিয়ে গেছে শত শত হেক্টর আমনের বীজতলা। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, হ্যাচারি, পুকুর।
কক্সবাজার সদরের ঝিলংঝা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা নিচু হওয়ায় পানিতে ডুবে আছে। এসব এলাকার লোকজনকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়।
পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা বলেন, পাহাড়ি ঢলে পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, উজানটিয়া, মগনামা, টৈটং, বারবাকিয়া, শিলখালী ও রাজাখালী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে নিরাপদ পানি, খাবারের সংকট দেখা গেছে। বানৌজা শেখ হাসিনা সড়কসহ অনেক সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা মুস্তফা বলেন, উপজেলার ফতেখাঁরকুল, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, চাকমারকুল, রাজারকুল, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়িসহ বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাঁকখালীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতে বিভিন্ন গ্রামের সাঁকো ভেসে গেছে। ফলে স্থানীয়রা ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় পারাপার করছেন। বন্যা দুর্গতদের ২ মেট্রিক টন চাল ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে শুকনো খাবারও।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, জেলার ৬০ ইউনিয়নে তিন লক্ষাধিক মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন উপজেলায় প্রাণহানি হয়েছে ৫ জনের। দুর্গত মানুষদের জন্য ২০৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। সেসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৪০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। চকরিয়া-পেকুয়ায় ৪৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক, উখিয়ায় ৩ কিমি কাঁচা সড়ক এবং টেকনাফ মহাসড়কে আড়াই কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিবর্ষণে দুর্গতদের ইতোমধ্যে ৫৮ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে সকল বিভাগ একীভূত হয়ে কাজ করছে।