কম্বোডিয়ায় কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার নামে তরুণ-তরুণীদের ফাঁদে ফেলা হয়। এর পর তাদের ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশে নিয়ে অনলাইনে প্রতারণার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয় প্রতারণায় জড়িত আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। সেখানে ফেসবুকে ছদ্ম পরিচয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়। কাজ করতে না চাইলে চালানো হয় নির্যাতন। দেশে ফিরতে চাইলেও ঘাটে ঘাটে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এমনকি চক্রের জন্য আরও ‘ভুক্তভোগী’ সংগ্রহ করে দিতে হয়। এমনই অভিনব কায়দায় তরুণ-তরুণীদের পাচার করে ‘সাইবার ক্রীতদাস’ হিসেবে বিক্রিতে জড়িত চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- চক্রের মূল হোতা নাজমুল ইসলাম, তার সহযোগী নূর ইসলাম সাজ্জাদ ও সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েত। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টন এলাকায় এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, চারটি মোবাইল ফোন, একটি রেজিস্টার, ২৫০ পাতা মানব পাচার সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং নগদ ৫ হাজার ১৬ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাব-৩ এর স্টাফ অফিসার এএসপি ফারজানা হক জানান, মানব পাচার চক্রের মূল হোতা কম্বোডিয়া প্রবাসী নাজমুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ থেকে উচ্চ বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেওয়ার নামে ভুক্তভোগীদের প্রলুব্ধ করেন। দালালদের মাধ্যমে শিক্ষিত, কম্পিউটার বিষয়ে পারদর্শী বেকার তরুণ-তরুণীদের এ ফাঁদে ফেলা হয়। কম্বোডিয়ায় পাঠানোর খরচ বাবদ প্রাথমিকভাবে তারা ৪-৫ লাখ টাকা নেন। আগ্রহীদের প্রথমে কম্পিউটার বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কম্বোডিয়া প্রবাসী আলীম ও শরিফুলের সহায়তায় ট্যুরিস্ট ই-ভিসা করে তাদের পাঠানো হয়। সেখানে নাজমুল তাঁর সহযোগী রাকিব ও রফিকের সহায়তায় চাকরি প্রত্যাশীদের আরিফের হোটেলে নিয়ে যান এবং তাঁদের পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেন। হোটেলে কিছুদিন অবস্থানের পর তাঁদের কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কম্বোডিয়া প্রবাসী কামাল ওরফে লায়ন কামাল ও আতিকের সহায়তায় একটি বিদেশি সংস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়।
ফারজানা হক জানান, বিদেশি প্রশিক্ষকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছদ্মনামে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে প্রতারণা, ভুয়া ও ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা আত্মসাতের কৌশল, ভুয়া নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বা চ্যাট করে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার নামে কৌশলে ডিপোজিট হাতিয়ে নেওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকর্ড করে পরে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাতের কৌশল শেখান। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের একটি বিদেশি কোম্পানির কাছে দুই-তিন হাজার ডলারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এর পর তাঁদের একটি সুরক্ষিত ভবনে নিয়ে তল্লাশি করে সব রকম ইলেকট্রনিক ডিভাইস কেড়ে নেওয়া হয়। পরে তাঁদের কম্পিউটার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি বড় ঘরে তিন-চারশ ডেস্কটপ কম্পিউটার সাজানো থাকে। সেখানে ভুক্তভোগীদের ফেসবুকে ছদ্মপরিচয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে নারীদের সঙ্গে পুরুষ এবং পুরুষদের সঙ্গে নারী হিসেবে বন্ধুত্ব গড়তে বলা হয়। এর পর সেই নারী-পুরুষদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়।
র্যাব-৩ এর স্টাফ অফিসার জানান, কেউ টার্গেট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে বা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। তাঁর খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেউ কাজ থেকে অব্যাহতি চাইলে তাঁকে কিনতে যে পরিমাণ ডলার ব্যয় হয়েছে, তার দ্বিগুণ ফেরত দিতে হয়। তখন ভুক্তভোগী বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ওই প্রতিষ্ঠানে দিয়ে কম্বোডিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি দালালদের আশ্রয়ে যান। দালালরা আবারও তাঁদের আরেকটি সাইবার প্রতারক কোম্পানিতে বিক্রি করে দেন। কেউ দেশে ফিরে আসতে চাইলে দেশে ফেরত যাওয়ার শর্ত হিসেবে আরও গ্রাহক সংগ্রহ করে দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। তখন ভুক্তভোগী নিরুপায় হয়ে নিজে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাঁর পরিচিত অপর বাংলাদেশিদের কম্বোডিয়ায় আসতে প্ররোচিত করেন।