করোনাকালে মূল হজ অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ থাকায় দেশের লাখ লাখ মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ ২০২০-২০২১ সালে দুই বছর হজ পালন করতে পারেননি। সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশের নয়—সমগ্র মুসলিম বিশ্বের চিত্রই এক। সংগত কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ ওমরাহ হজব্রত পালনের জন্য প্রতিনিয়ত সৌদি আরবে যাচ্ছেন।
একই উদ্দেশ্যে সশরীরে সৌদি আরবে উপস্থিত হয়ে বিষয়টা সম্যক উপলব্ধি করা গেল। হোটেল-মোটেল ও হজযাত্রীদের জন্য ব্যবহৃত প্রাইভেট বাড়িঘরে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। মক্কায় ‘মসজিদুল হারাম’ এবং মদিনায় ‘মসজিদুল নববী’তেও মূল হজকালীন অবস্থা বিরাজ করছে। প্রত্যেক ওয়াক্তে হাজিদের নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে স্থান সংকুলান করতে কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছেন। আগামী হজ অনুষ্ঠানে বিশ্বের সব দেশ থেকে হজ-প্রত্যাশী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের চাপ মোকাবিলা করতে সৌদি সরকারকে হিমশিম খেতে হবে সন্দেহ নেই।
এই যে ব্যাপকহারে ওমরাহ হজ পালন করা হচ্ছে তার কোনো তথ্য সরকারের হাতে নেই। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের উপসচিব, অতিরিক্ত সচিব অথবা অন্য কোনো কর্মকর্তা এই হিসাব দিতে পারেননি। তারা সবাই এই তথ্য তাদের কাছে থাকা উচিত ছিল বলে স্বীকার করলেও ২০১২ সালের পর থেকে তা নথিভুক্ত করা হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
দেশ থেকে লাখ লাখ নাগরিক অন্য দেশে যাচ্ছেন—তা যে কোনো উপলক্ষ্যেই হোক, সেই তথ্য আমাদের দেশের সরকারের কাছে থাকবে না—এ কেমন কথা! চিকিৎসা, পর্যটন, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, চাকরি, ইত্যাদি নানা প্রয়োজনে দেশের মানুষ বিদেশে গেলে, সেই তথ্য লিপিবদ্ধ করা হলে ওমরাহ হজযাত্রীদের বিষয়টা কেন করা হয় না? বিশেষ করে হজব্রত পালনের পর হজযাত্রীদের দেশে ফিরে আসা, মৃত্যু ও অসুস্থতার কারণে ফিরতে না পারা, চাকরির প্রত্যাশায় সৌদি আরবে আত্মগোপন করা, হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এবার আসা যাক, হজ ও ওমরাহ বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আল্লাহর ঘরের মেহমানদের যারা হয়রানি করবে, তাদের কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, হজযাত্রীদের প্রাক-নিবন্ধন, নিবন্ধন, ই-হেলথ প্রোফাইল তৈরি, ই-টিকিট, হজযাত্রী পরিবহন, মক্কা-মদিনায় আবাসন ব্যবস্থা, চিকিৎসাসেবা দেওয়াসহ সবক্ষেত্রে ই-হজ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। সরকারের এসব ভালো উদ্যাগগুলো সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে বিশেষ করে ওমরাহ হজযাত্রীরা সুফল পাচ্ছেন না। অসুস্থ হলে কোথায় চিকিৎসা নেওয়া যাবে কিংবা অন্যান্য নির্দেশনা কীভাবে, কোথায় পাওয়া যাবে তা জানানোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া মক্কা-মদিনায় সৌদি সরকার ভিন্ন ভাষাভাষীদের সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক ভাষা জানা কর্মীদের সমন্বয়ে তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা না করায় সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। সারা বিশ্ব থেকে আসা বিপুলসংখ্যক হজ ইবাদত পালনকারী মানুষের সুবিধার্থে বিষয়টি নিয়ে সৌদি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার বিকল্প কিছু নেই।
পবিত্র ওমরাহ হজ পালন শেষে মক্কা জিয়ারার (পরিদর্শন) উদ্দেশে আমাদের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট দলটি প্রথমে জাবালে সাওর (সাওর পর্বত) পরিদর্শন করি। অতঃপর আমাদের মোয়াল্লেম তানভীর হুসেইনের পরিচালনায় আমরা বাস থেকে আরাফতের ময়দান (জামালে রহমত) পরিদর্শন করি। ময়দানটি মক্কা নগরী থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আরাফতের ময়দানে চোখে পড়ার মতো সারি সারি নিমগাছগুলো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়ে রোপণ করা হয়েছে।
আরাফাতের ময়দান অতিক্রম করে আমরা বাস থেকে ‘মুজদালিফা’ এবং ‘মিনা’ পর্যবেক্ষণ করতে করতে ‘জাবালে নূর’ বা হেরা গুহার নিকটবর্তী স্থানে নেমে পড়ি। এখানে মোয়াল্লেম সাহেব আমাদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেন যে, হেরা পর্বতটিতে ওঠানামা করা বেশ কষ্টসাধ্য। অথচ নবি করিম (সা.) নিয়মিত এই পর্বতে ওঠানামা করতেন।
সবশেষে মদিনায় জিনের পাহাড়ে (ওয়াদি জিন) ঘুরে আসার মাধ্যমে আমাদের সৌদি আরবে ওমরাহ হজ সফরের কার্যক্রম শেষ হয়। ফেরার পথে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাতায়াতের সুবিধা-অসুবিধা কিছুটা না বললে লেখাটি পূর্ণাঙ্গ হবে না বিচার করে কিছু টুকিটাকি বিষয় উল্লেখ না করে পারলাম না। জেদ্দা বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রাত ১১ :৪০ মিনিটে বিজি ৩৩৮ নম্বর ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশ্যে উড়াল দিলে বিমানের বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হিসেবে লক্ষ করলাম আদর-আপ্যায়নের তোড়জোড় চলছে। কে কী ডিনার খাবেন সেই তথ্য জেনে নেওয়া হচ্ছে। তবে সৌদি আরব যাওয়া এবং ঢাকায় ফিরতি ফ্লাইটের আগে ঢাকা ও জেদ্দা বিমানবন্দরে খাবারের মেন্যুতে আকাশ-পাতাল পার্থক্য প্রশ্নের উদ্রেক করে। যতদূর জানা গেছে, উভয় বিমানবন্দরে খাবারের জন্য ১৮৪ রিয়াল বরাদ্দ রাখা আছে। তাহলে জেদ্দা বিমানবন্দরে আইটেম কম ও মান এত নিচু কেন? যতদূর জানা যায়, বিমানের বিভিন্ন ফ্লাইটের টিকিট ক্রয়ের সময় প্রায়ই বলা হয়, ‘আসন বুকড হয়ে গেছে’। পরে ভ্রমণের সময় দেখা যায় অসংখ্য আসন ফাঁকা। আমি যেদিন ভ্রমণ করছিলাম, সেদিনও বিজনেস ক্লাসে পাঁচটি এবং ইকনোমি ক্লাসে ৮৪টি আসন ফাঁকা ছিল।
বিমানে ভ্রমণের সময় অনেক সময় যাত্রীরা লক্ষ করেন, তাদের আসনে ‘গিফট প্যাকেট’ রাখা আছে। বিষয়টি যাত্রীদের অবহিত করার ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে গিফটের সঙ্গে কম্বলও সঙ্গে নিয়ে নেমে যান। এ ব্যাপারে যথাযথভাবে অবহিতকরণের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক বলে যাত্রীরা মনে করেন।