করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর বই উৎসব হয়নি। তবে এবার বছরের প্রথম দিন তথা ১ জানুয়ারি সারা দেশে উদযাপিত হয় ‘বই উৎসব’। এদিন সারা দেশের স্কুলগুলোতে একযোগে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া হয়। বই পেয়ে শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই বেশ খুশি। খুশি অভিভাবকেরা। খুশি আমরাও। সব ক্লাসের সবগুলো বই হয়তো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো যায়নি, তবে খুব শিগিগর পৌঁছে যাবে বলেই সবার প্রত্যাশা।
বই উৎসবের দিনটা সব শিক্ষার্থীর কাছেই একটা অন্যরকম দিন। আনন্দের দিন। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেওয়ার যে একটা মজা, তা প্রায় সব শিক্ষার্থীই উপভোগ করে থাকে। নতুন বই মানেই নতুন পাঠ। এবং অবশ্যই নির্ভুল পাঠ। আর এই নির্ভুল পাঠের বিষয়টি নিশ্চিত করা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন সংশ্লিষ্টদের একান্ত দায়িত্ব। যদিও এ নিয়ে সময়ে সময়ে শোনা যায় নানা কথা!
অস্বীকার করার উপায় নেই, একটি নির্দিষ্ট দিনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর হাতে যথাসময়ে বই পৌঁছানো একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাঠ্যপুস্তক-সংশ্লিষ্টদের সবার ভেতরেই একটা চাপ থাকে। যে চাপের দরুন বইয়ে ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি (যদিও না হওয়াটাই কাম্য) হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই ক্রটিবিচ্যুতি যদি প্রতিবারই থাকে, তবে তো তা হতাশার। পাঠ্যপুস্তকের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে প্রতিবারই। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও! শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া এ বছরের পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক দিক ইতিমধ্যে অনেকেই কমবেশি জেনেছেন। বলা হচ্ছে, বইয়ের কাগজের মান অত্যন্ত নিম্নমানের। এছাড়া কিছু কিছু বইয়ের ছাপা অস্পষ্ট হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সেসব বই পড়তে অসুবিধার সম্মুখীন হবে। আরো দেখা যাচ্ছে, পুরোনো তথ্য-উপাত্ত রয়েছে অনেক বইয়েই—হালনাগাদ করা হয়নি। প্রাথমিক স্তরের তৃতীয় শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচিতি’ বইয়ের ৬৮ নম্বর পৃষ্ঠায় দেখা যায়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা পরিচিতিতে আগের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই অধ্যায়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নির্ণয়ে ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ জন উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ঐ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার বলা হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে মিয়ামারের সমুদ্রসীমার ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। বর্তমান সরকারের এটি একটি বড় অর্জন। দীর্ঘদিন হয়ে গেলেও পাঠ্যপুস্তকে এই অর্জনের বিষয়ে কিছুই তুলে ধরা হয়নি। বাংলাদেশের আয়তন হিসেবে সেটা দেখানোও হয়নি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসাব ও আয়তনে এই একই ধরনের পুরোনো তথ্য তুলে ধরা হয়েছে চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়েও। আরো উল্লেখ করতে হয়, উক্তরূপ পুরোনো তথ্য গতবারের পাঠ্যপুস্তকে ছিল এবং তা ধারাবাহিকভাবে এবারও আছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, পাঠ্যবইয়ে এমন ত্রুটিবিচ্যুতির থাকার কথা সামনে এলেও তা পরবর্তী মুদ্রণে সংশোধন করা হয় না কেন? এ রকম মাধ্যমিক স্তরের বইয়েও কিছু অসংগতি থাকার কথা শোনা যাচ্ছে। নবম-দশম শ্রেণির তিনটি বইয়ে বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে। এই চিত্র কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব অসংগতি ও ত্রুটিবিচ্যুতি দ্রুত সংশোধন করা হবে, এমনটাই আশা সবার।
সত্যি বলতে, বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের এই বই দেওয়ার ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে। এই অতুলনীয় কাজটি সরকার প্রতি বছরই বেশ সফলতার সঙ্গেই করছে। তবে ছাত্রছাত্রীদের হাতে সময়মতো বই তুলে দেওয়াকে যেরূপ গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেরূপ গুরুত্ব দিতে হবে বইয়ের মানের প্রশ্নেও। এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেই আমরা মনে করি।