প্রায় সাড়ে ৪ কোটি রুপি খরচ করে ২০১২ সালে ‘চিটাগাং’ নামে একটি হিন্দি ছবি বানিয়েছিলেন বেদাব্রত পাইন। ছবিটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ছবির নির্মাণ নিঃসন্দেহে চমৎকার, কিন্তু বলিউডের সেটে চিটাগাংয়ের বনজ পরিবেশ মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। সত্যিকার অর্থে পিরিয়ডিক্যাল ছবি নির্মাণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এখানে অনেক বেশি বাজেট লাগে। শিল্প নির্দেশকের অত্যন্ত কঠিন দায়িত্ব থাকে। প্রপ্স এবং সামগ্রিক সবকিছু সেই সময়ের মতো হওয়া চাই।
সুতরাং প্রদীপ ঘোষ যখন সেলিনা হোসেনের কাহিনি নিয়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বগাথার ওপর ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন এবং সেই সংবাদ যখন আমার এক বাল্যবন্ধুর সূত্রে জানতে পারলাম, তখন আমার চোখে ‘চিটাগাং’ ছবিটি ভেসে উঠছিল, যেখানে উঠে এসেছে মাস্টারদা সূর্যসেন ও প্রীতিলতাদের আত্মত্যাগের কাহিনি। আমার বাল্যবন্ধু কামরুজ্জামান তাপু ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ সিনেমায় মাস্টারদা সূর্যসেন চরিত্রে অভিনয় করেছে। বিশাল চ্যালেঞ্জিং কাজ। সে কারণে ছবিটি মুক্তির পর তাপুর সঙ্গে সন্ধ্যার শোতে যখন সিনেপ্লেক্সে টিকিট কেটে ঢুকলাম, তখন জনা চল্লিশেক দর্শক দেখে বেশ সাহস পেলাম। আমি এতজন দর্শক আশা করিনি। এমনিতেই ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের কাহিনি, তার ওপর অ্যাভাটার-২ চলছে। অ্যাভাটার-২ কিংবা আরো কিছু বিশাল বাজেটের মুভি বাদ দিয়ে কে দেখবে ‘স্লো মুভি’। হ্যাঁ, এসব ছবিকে স্লো ছবিই বলা হয়। আসলে সব ছবি সবার জন্য নয় এবং স্লো ছবিরও বিশেষ দর্শক আছে। তবে স্লো ছবি বলে যে নেতিবাচক তকমা দেওয়া হয়, আদতে এসব ছবি তা নয়। এসব ছবি আমাদের চিন্তার জায়গাকে উসকে দেয়। এসব ছবি দেখতে হয় মাথা দিয়ে।
‘মাস্টারদা সূর্যসেনের’ পাশে বসে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ দেখে প্রথমেই মনে হয়েছিল, প্রীতিলতার আরেকটু কালো হওয়া দরকার ছিল। তার ভ্রুটা আরেকটু অবিন্যস্ত হওয়া দরকার ছিল। অবশ্য ছোট প্রীতিলতার চরিত্রের ভেতরে বালিকা প্রীতিলতা ঠিকঠাক ফুটে উঠেছে। তবে তিশাকে ‘প্রীতিলতা’ কম মনে হয়েছে। যদিও তিশা প্রেসের কাছে বলেছেন, ‘প্রত্যেকটা শিল্পীরই এ ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের স্বপ্ন থাকে। আমি এ ছবিতে আমার স্বপ্নের চরিত্রে অভিনয় করতে পেরেছি।’ তিনি অভিনয় নিঃসন্দেহে ভালো করেছেন, তবে মেকআপে আরো সিরিয়াস হওয়া দরকার ছিল। ফাঁসির আসামি রামকৃষ্ণের চরিত্রে মনোজ প্রামাণিক এত অসাধারণ করেছেন যে, যতক্ষণ মনোজ পর্দায় ছিলেন তাকে অপলক তাকিয়ে দেখতে হয়েছে। তার প্রতিটি এক্সপ্রেশন-ডায়লগ পরিমিত ও যথাযথ বলা যায়।
আর তাপুকে প্রথমে এবং বিরতির পর বেশ ভালো একটা সময় জুড়ে পর্দায় দেখা যায়। মাস্টারদা সূর্যসেন চরিত্রটার মধ্যে যে বিশালত্ব রয়েছে, সেটা ধারণ করে, এক্সপ্রেশন ও ডায়লগ দেওয়া যে কোনো অভিনেতার জন্য অ্যাসিড টেস্টের মতো। আমি পর্দায় মাস্টারদা সূর্যসেনকে দেখে তাপুর কথা ভুলে গেছি। আমার মনে হয়নি—একে আমি চিনি, এ আমার পাশেই বসে আছে। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে, তাপু এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেছে। বিপুল বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি এই ভেবে—তাপু ভয়কে জয় করেছে। এর বড় কৃতিত্ব পরিচালক প্রদীপ ঘোষেরও নিশ্চয়ই। আসলে সিনেমা তো ডিরেক্টরস মিডিয়া। এখানে ভালো কিছুর প্রশংসা পরিচালকের এবং সকল নিন্দাও পরিচালকেরই প্রাপ্য।
ছবির শুরুতে পর্দায় ফুটে উঠেছিল বিশেষ অনুপ্রেরণাদাতা হিসেবে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের নাম। প্রিমিয়ার শোতেও তিনি বলেছেন, প্রীতিলতা এবং চট্টগ্রামের বিপ্লবী আন্দোলনের বইপত্রগুলো তিনি কৈশোরে পড়েছেন এবং প্রীতিলতা, সূর্যসেন ও তার বিপ্লবী আন্দোলনের সমস্ত সদস্য যারা ছিলেন এবং তাদের কর্মকাণ্ড সবকিছুর ওপর তার এমন অনুরাগ জন্মে ছিল যে, সেই বয়সে তিনি স্বপ্ন দেখতেন—কিশোর বিপ্লবী হবেন।
প্রীতিলতা সূর্যসেনের বিপ্লবী আন্দোলনের একজন সদস্য ছিলেন। তার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ করার, যেখানে লেখা ছিল ‘ইন্ডিয়ানস অ্যান্ড ডগস আর নট এলাউড। ইউরোপিয়ানরা সেই ক্লাবে যেত এবং শুধু তাদের প্রবেশাধিকার ছিল, কুকুর এবং ভারতীয়দের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। প্রীতিলতা পুরুষের বেশে সেখানে আক্রমণ করে ফিরে আসার সময় আহত হন এবং ধরা পড়ার পরেই পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা করার কারণ ছিল এই যে, প্রীতিলতা যদি বন্দি অবস্থায় থাকতেন, তাহলে তাকে নির্যাতন করে তাদের বিপ্লবী আন্দোলনের সমস্ত পরিকল্পনা ব্রিটিশরা জেনে যেত। সেটি যাতে না হয়, সে জন্য তিনি নিজের জীবনটাই সঁপে দিয়েছেন।
এ ছবির ভিএফএক্স নিয়ে বলার কিছু নেই। এত কম বাজেটের ছবিতে ভিএফএক্স ব্যবহারের সাহসটাই অনেক বেশি। তবে ছবিটির আরেকটু মেদ ঝরানো যেত, সময় তাতে ১০-১৫ মিনিট কমে যেত। যেটা দারুণ ব্যাপার, প্রীতিলতার আত্মাহুতির পর তার সঙ্গে থাকা একটি চিঠি দর্শকদের শোনানো হয়। প্রীতিলতা একজন মানবিক, বুদ্ধিমতি নারী। কিন্তু তিনি কেন ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ করলেন? এর ব্যাখ্যা আছে অসাধারণ সেই চিঠিতে। তাপু জানাল, তথ্যমন্ত্রী মহোদয়ই চেয়েছিলেন এই চিঠিটা ছবির শেষে যুক্ত করা হোক। নিঃসন্দেহে এটা একটা অসাধারণ সমাপ্তি। ধন্যবাদ তথ্যমন্ত্রী মহোদয়কে। আমি দেখেছি, ছবি শেষে দর্শকরা নীরবে অশ্রুসজল চোখে হল থেকে বের হচ্ছেন। একজন পরিচালকের জন্য এটা একটা দারুণ অর্জন। অভিবাদন রইল প্রদীপ ঘোষের জন্য। প্রথম ছবিতেই তিনি দর্শকের মর্মে পৌঁছুতে পেরেছেন।