বর্তমানে বিশ্বে ৬২টি রাষ্ট্র রয়েছে, যাদের জনসংখ্যা ৩০ লাখের কম। আয়তন কম হওয়ার কারণে এসব রাষ্ট্রের ভৌগোলিক প্রভাব সীমিত। ক্ষমতাবান প্রতিবেশীর পাশে অবস্থিত হলেও আর্মেনিয়া, মলদোভা বা গাম্বিয়া ভূরাজনৈতিকভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ব্যতিক্রম হচ্ছে কাতার। মার্কিন ডেলাওয়ের রাজ্যের চেয়েও ছোট এই জনাকীর্ণ ও ধুলিকাময় উপদ্বীপটি পারস্য উপসাগর ও সৌদি আরবের দক্ষিণে অবস্থিত। কাতারের বর্তমান জনসংখ্যা ২০ লাখ ৮০ হাজার (যা ইউরোপের আলবেনিয়ার চাইতেও কম) হলেও এর নাগরিক মাত্র ৩ লাখ ২০ হাজার। বাকি জনগণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জীবিকার জন্যে আসা অভিবাসী। ১৯৩৯ সালে পেট্রোলিয়াম আবিষ্কারের পূর্বে কাতারের নাগরিকদের মূল পেশা ছিল মৎস্য শিকার বা মনি মুক্তার জন্য পারস্য উপসাগরে সন্ধান করা। কাতারের পশ্চিমের ‘দুখান’ অঞ্চলে তেল আবিষ্কারের বছর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ, যা এ শিল্পের বিকাশকে প্রলম্বিত করে। কিন্তু কাতার থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সৌদি আরবের বৃহত্তর তেল খনি ‘ঘাওয়ার’ তখন কাতারের সব তেল খনির চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদন করে যাচ্ছিল। এ সময়ে কাতারে বিশ্বের ১৪তম বৃহৎ তেলক্ষেত্র থাকলেও তা পার্শ্ববর্তী কুয়েত ও সৌদির তুলনায় ছিল সামান্য। ১৯৭১ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন মার্কিন শেল কোম্পানির সহায়তায় পারস্য উপসাগরের নিজ সীমার অভ্যন্তরে কাতার আবিষ্কার করে এমন একটি গ্যাসক্ষেত্র যেখানে পৃথিবীর মোট গ্যাসের পাঁচ ভাগের এক ভাগ রয়েছে। এই আবিষ্কার রাশিয়া ও ইরানের পর কাতারকে বিশ্বের ৩য় শীর্ষ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ মজুত) প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতের দেশে পরিণত করে। জ্বালানি হিসেবে গ্যাস আজকের মতো কার্যকরী না থাকায় ও নতুন তেলক্ষেত্র না পাওয়ায় এ আবিষ্কার ৭০-এর দশকে শেল কোম্পানি কিংবা কাতার সরকারকে আনন্দিত করতে পারেনি। কেননা সরাসরি গ্যাস রপ্তানি ছিল ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এই সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবিত হয় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি যা গ্যাসকে তরলে পরিণত করে এর আয়তন ৬০০/১-এ নামিয়ে আনে ও জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন যোগ্য করে তোলে। কিন্তু এটিও ছিল যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। ইউরোপ প্রয়োজনীয় গ্যাস তখন পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া, নরওয়ে, আলজেরিয়া ও নেদারল্যান্ডস থেকে আমদানি করত। জাপান, তাইওয়ান ও দক্ষিণ করিয়ায় এলএনজির চাহিদা থাকলেও তা ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে নিকটে থাকা ও ১৯৭৩ সালে আরব দেশগুলো তেল উৎপাদন হ্রাস করলে শেল কোম্পানি কাতারে তেল উৎপাদনে অধিক মনোযোগ দেয় এবং এলএনজি পরিকল্পনা ত্যাগ করে।
২০ বছর পর ৯০-এর দশকে বৈশ্বিক তেলের বাজারে ধস, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রযুক্তির বিকাশ কাতারকে আবার তার এলএনজি প্রকল্পের দিকে ধাবিত করে। বিদ্যুত্ উৎপাদনে তেলের চেয়ে ৩০% ও কয়লার চেয়ে ৫০% কম কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকারী প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা তখন ক্রমবর্ধমান। ১৯৯৫ সালে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হামাদ বিন খালিফা আল থানি নিজ পিতাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন ও কাতারকে বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত করতে মনোযোগী হন। মার্কিন এক্সন মোবিল কোম্পানির সহায়তায় এবার কাতার বড় পরিসরে এলএনজি রপ্তানি শুরু করে। কাতারে স্থাপিত হয় বিশ্বের বৃহত্তর কৃত্রিম বন্দর ও বাণিজ্য কেন্দ্র ‘রস লাফন’। ১৯৯৬ সালে হরমুজ প্রণালি দিয়ে কাতার তাদের এলএনজি রপ্তানি শুরু করে জাপানে। ২০০৬ সালে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে হটিয়ে কাতার বিশ্বের বৃহত্তর এলএনজি রপ্তানিকারকে পরিণত হয়। জাপান, তাইওয়ান ও দক্ষিণ করিয়ায় কাতারের এলএনজি তখন সিংহভাগ।
১৯৯৬ সালে কাতারের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১০ হাজার ডলারের নিচে, যা ২০২১ সালে ১ লাখ ডলার অতিক্রম করে। কিন্তু এর ফলে দেখা দেয় নতুন একটি সমস্যা। ২০১০ সাল নাগাদ সরকারের ৭০% রাজস্ব, দেশের ৬০% জিডিপি ও রপ্তানি আয়ের ৮৫% এর উত্স ছিল পেট্রোলিয়াম রপ্তানি। অর্থাত্ কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এ খাত হুমকির সম্মুখীন হলে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে দেশের অর্থনীতির জন্য। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে ঢেলে সাজানো হয় ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কাতার এয়ারওয়েজ, যা বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ এয়ারলাইনসের একটি। প্রতিষ্ঠা করা হয় আলজাজিরা মিডিয়া, যার অর্থ উপদ্বীপ। শুরু হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা খাতে কাতারের বিনিয়োগ। অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণে কাতার আগ্রহ দেখায়, যা সেসব অঞ্চলের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বর্তমানে বিশ্বে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ নিয়ে এখন কাতারের আছে ৯ম বৃহত্তর সার্বভৌম সম্পদের ফান্ড, যেখানে উল্লেখযোগ্য ফরাসি পারিস-সেইন্ট জারমেইন ফুটবল ক্লাবের পূর্ণ মালিকানা (বিশ্বের ৭ম ধনী ফুটবল ক্লাব), লন্ডনে অবস্থিত পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম বিল্ডিং ‘দা শার্ড’-এর ৯৫% মালিকানা, বিশ্বের ৭ম ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট হিথ্রো-এর ২০% মালিকানা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে কাতারের জনগণের মাথাপিছু সম্পদ দাঁড়ায় ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। পারস্য উপসাগরে ইরান ও কাতার একই গ্যাসক্ষেত্র ভাগাভাগি করে ব্যবসা করতে থাকে, যার ফলে প্রতিবেশী সৌদি আরবের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে কাতার মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে ‘আল উদেইদ’ বিমান ঘাঁটি নির্মাণে সহযোগিতার আহ্বান জানায়, যা পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর বিমান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহযোগিতায় কাতার এশিয়াতে মার্কিন মিত্রদের কাছে এলএনজি রপ্তানি বৃদ্ধি করে। ২০২২ সালের শুরুতে বাইডেন প্রশাসন জাপান, কানাডা ও ব্রাজিলের পাশাপাশি কাতারকে নন-ন্যাটো মিত্র ঘোষণা করে।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পূর্বেই কাতারের অর্থনীতি ইউক্রেনের ১৬/১ ভাগ জনসংখ্যা নিয়ে তাকে ছাড়িয়ে যায়। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ কাতারের জন্য ইউরোপে এলএনজির নতুন বাজার সৃষ্টি করে। ক্ষুদ্র আকৃতি ও জনসংখ্যার পরও নিজের চেয়ে ডজন সমান বড় রাষ্ট্রের মতোই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে কাতার ক্ষমতা, আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বিশ্বের ৯ম বৃহত্তর এয়ারপোর্ট কাতার এয়ারওয়েজ, বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন, বিশ্বের ২য় বৃহত্তর সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার পরিচালনা ইত্যাদি বর্তমান সময়ে কাতারকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস কিংবা তুর্কিয়ের চেয়ে আয়তন ও জনসংখ্যায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে কাতার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এসব দেশের সমান প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।