ডঃ মোঃ সোহেল রানাঃ-
কম্পিউটারের ইতিহাস খুবই রোমাঞ্চকর এবং মজার, যার শুরুটা হয়েছিল মানুষের গণনা এবং হিসাবের জন্য তৈরি যন্ত্র উদ্ভাবনার মধ্য দিয়ে। চলুন, একটু বিস্তারিত দেখে আসি।
সাল টি ছিল ১৮০১, ফ্রান্সের বিচিত্র এক ছোট শহর যার নাম ছিল লিয়ন। সেখানে জোসেফ মারি জ্যাকার্ড নামে একজন তাঁতি এবং বণিক বাস করতেন। তিনি কাপড় বুননে এতটাই পারদর্শি একজন তাঁতি ছিলেন যে, তার উৎপাদিত কাপড়ের জটিল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেত সবাই। সে যাইহোক, ভদ্রলোক একদিন তার কর্মশালায় কাপড় বুননের কাজ করেছিলেন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি চিন্তা করছিলেন যে, এমন কোন যন্ত্র কি আবিষ্কার করা যায় না, যা শ্রমসাধ্য এই বুনন প্রক্রিয়ায় বিপ্লব ঘটাতে পারে? যন্ত্রটি এমন হতে হবে যা এই বুনন প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে সক্ষম হবে অর্থাৎ যন্ত্রটি একা একাই কাজ করতে পারবে। ভেবে দেখুন তো এটা সেই ১৮০০ সালের কথা। ভদ্রলোক সেই সময়ে অটোমেশন নিয়ে কতটা দূর পর্যন্ত ভেবেছেন।
অতঃপর, বছরের পর বছর অক্লান্ত শ্রম আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, ভদ্রলোক অবশেষে প্রকাশ করলেন তার আবিষ্কার – একটি লুম (তাঁত) যা পাঞ্চ করা কাঠের কার্ড ব্যবহার করে বুননো ফ্যাব্রিকের প্যাটার্ন নিয়ন্ত্রণ করত। তিনি তো প্রথম দিকে বুঝতেই পারেননি যে, তার এই উদ্ভাবনী সৃষ্টি একটি অসাধারণ ভোরের সূচনা করবে – কম্পিউটিংয়ের যাত্রা।
প্রায় কুড়ি বছর পর অর্থাৎ ১৮২২ সালের দিকে, সমগ্র ইংলিশ চ্যানেল জুড়ে তখন চার্লস ব্যাবেজ (যাকে আমরা আধুনিকে কম্পিউটারের জনক হিসেবে জানি এবং মানি) নামের একজন উজ্জ্বল গণিতবিদ কে নিয়ে জয় জয়কার অবস্থা।
ভদ্রলোক একটি বাষ্পচালিত গণনা যন্ত্র উদ্ভাবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন যা কিনা নির্ভুলতার সাথে জটিল সংখ্যার গণনা করতে পারবে। তিনি অবশ্য এই কাজের জন্য ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে কিছু তহবিলও পেয়েছিলেন। কিন্তু, তার উচ্চাভিলাষী এই প্রকল্পটি আসলে ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছিল, আপাতদৃষ্টিতে সময়ের কাছে হেরে যান তিনি। এইদিকে সময় তার সঠিক গতিতেই এগিয়ে চলছিল সম্মুখপানে। ১৯৩৬ সালে অ্যালান টুরিং নামে আরও একজন স্বপ্নদর্শী গণিতবিদকে আমরা পাই, যিনি টিউরিং মেশিন নামের একটি সার্বজনীন যন্ত্রের ধারণা প্রবর্তন করেন।
ভদ্রলোকের এই তাত্ত্বিক যন্ত্রটি গণনাযোগ্য যে কোনও কিছু গণনা করতে সক্ষম, যা কিনা আজকের আধুনিক কম্পিউটারের ভিত্তি স্থাপন করে।
১৯৪০ এর দশকের গোড়ার দিকে বিষয়টি একটি বাস্তব মোড় নেয় যখন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক, জন মাউচলি এবং জে. প্রেসার একার্ট, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে ইলেকট্রনিক নিউমেরিক্যাল ইন্টিগ্রেটর এবং ক্যালকুলেটর (ENIAC) তৈরি করেন।
তারা যত্রটি তৈরি করতে ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করেন এবং এই বিশাল যন্ত্রটিকেই ডিজিটাল কম্পিউটারের পিতামহ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অতঃপর, ১৯৪৭ সালে, উইলিয়াম শকলি, জন বারডিন এবং ওয়াল্টার ব্র্যাটেন নামে তিনজন বিজ্ঞানী বেল ল্যাবরেটরিজ-এ, ট্রানজিস্টর উদ্ভাবনের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্সে বিপ্লব ঘটান। এই সলিড-স্টেট ট্রানজিস্টরটি ভ্যাকুয়াম টিউবের প্রয়োজনীয়তা দূর করে, পাশাপাশি ছোট এবং আরও দক্ষ কম্পিউটারের জন্য পথ তৈরি করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসে ১৯৫৮ সালে, যখন জ্যাক কিলবি এবং রবার্ট নয়েস নামের দুই ভদ্রলোক যখন ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা কম্পিউটার চিপ উন্মোচন করেন। যার ফলফল হিসেবে কিলবি সাহেব ২০০০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বছর অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে প্রযুক্তিরও উন্নতি সাধিত হয় এবং হয়েছে বিভিন্ন ভাবে, এবং ১৯৬৮ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে, ডগলাস এঙ্গেলবার্ট আধুনিক কম্পিউটারের একটি প্রোটোটাইপ প্রদর্শন করেন। ভদ্রলোকের উদ্ভাবিত যন্ত্রটিতে একটি মাউস এবং একটি গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI) রয়েছে, যা আজকের ব্যবহারকারী-বান্ধব কম্পিউটারগুলির পূর্বাভাস দেয়।
১৯৭৬ সালে যখন স্টিভ জবস এবং স্টিভ ওজনিয়াক মিলে যখন অ্যাপল প্রতিষ্ঠা করেন, বলতে গেলে তখনই ব্যক্তিগত কম্পিউটিং (যাকে বলা হয় PC বা Personal Computer) এর যুগ সত্যিকার অর্থে শুরু হয়। এপ্রিল ফুল দিবসে, তারা প্রথম অ্যাপল চালু করেন। একটি একক-সার্কিট বোর্ড সহ এটাই কোন প্রথম কম্পিউটার, যা একটি প্রযুক্তি জায়ান্টের উত্তরাধিকারের সূচনা করে। আর ১৯৮১ সালে যখন প্রথম IBM পার্সোনাল কম্পিউটার (যার কোড-নাম “Acorn”) প্রবর্তনের মাধ্যমে ধারনা টা আবার বদলে যায়।
মাইক্রোসফটের এমএস-ডস অপারেটিং সিস্টেম দ্বারা চালিত, একটি ইন্টেল চিপ, দুটি ফ্লপি ডিস্ক এবং একটি ঐচ্ছিক রঙের মনিটর সমন্বিত, এই মেশিনটি ব্যক্তিগত কম্পিউটিং-এর জন্য মান নির্ধারণ করে, যেটা কে আমরা সাধারণ মানুষ কম্পিউটার হিসেবে চিনি, জানি এবং ব্যবহার করি।
এই, কম্পিউটিংয়ের যাত্রা অব্যাহত, যেখানে প্রতিটি মাইলফলক অতীতের উদ্ভাবনের উপর ভিত্তি করে, ডিজিটাল সিস্টেম কে একটা নতুন রূপ দেয় যা আমরা আজ জানি। সেই পাঞ্চড কার্ড থেকে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, রুম-ফিলিং জায়ান্ট থেকে মসৃণ ব্যক্তিগত কম্পিউটার পর্যন্ত, প্রযুক্তির বিবর্তন মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং অগ্রগতির নিরলস সাধনার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক: – সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটিং এন্ড সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্লোরিডা গালফ কোস্ট ইউনিভার্সিটি