মলদোভা ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য নয়, কিন্তু গত বছর জুন মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একই দিনে ইউক্রেনের সঙ্গে মলদোভার সদস্যপদের আবেদনপত্রও গ্রহণ করে। তার অর্থ, ইউরোপীয় এই জোটে ঢোকার পথ অনেকটাই খুলে গেছে মলদোভার জন্য।
এ সপ্তাহের শুরুর দিকে মলদোভার প্রেসিডেন্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে দেখা করেন, এবং সেসময় বাইডেন মলদোভার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাহায্যের অঙ্গীকার করেন।
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি
২৬ লাখ জনসংখ্যার দেশ মলদোভা ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম। যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব যে দেশগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি পড়েছে, মলদোভা তাদের অন্যতম।
দেশটির অবকাঠামো এখনও সোভিয়েত আমলের।
জ্বালানির সংকট এখন চরম। বাকি ইউরোপের মত তাদের দেশেও রুশ জ্বালানির সরবরাহ কমেছে, ফলে দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।
মলদোভার প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় সবটাই আসতো রাশিয়া থেকে। কিন্তু ইউক্রেনকে সমর্থনের জন্য শাস্তি দিতে গ্যাসের সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে মস্কো।
শুধু তাই নয়, ইউক্রেনের বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর রাশিয়ার ক্রমাগত হামলার প্রভাব পড়ছে মলদোভার ওপরও।
ফলে, সানডু সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ ২০২০ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মলদোভাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকানোর চেষ্টা করে চলেছেন।
কিন্তু যুদ্ধের কারণে বাজারে জিনিসপত্রের দাম এবং সেইসঙ্গে ইউক্রেন থেকে দলে দলে শরণার্থীর চাপে দেশের ভেতর অস্থিরতা, অসন্তোষ বাড়ছে।
সেইসঙ্গে, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ইউক্রেনের উদ্দেশ্যে ছোড়া একটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র তাদের আকাশ সীমার ওপর দিয়ে যাওয়ার পর প্রতিবাদ জানাতে মলদোভার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রুশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। সেটি নিয়ে মস্কো আরও নাখোশ।
দেশের ভেতর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জনমনে তৈরি হওয়া অসন্তোষকে পূঁজি করে বিরোধী দলগুলো এখন সরকারবিরোধী তৎপরতা শুরু করেছে। প্রতি সপ্তাহে দেশজুড়ে তারা বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করছে।
সরকারের সবচেয়ে বিরোধিতা করছে রুশপন্থী দল শোর পার্টি। দলের নেতা ধনকুবের ইলান শোর যিনি এখন দেশ থেকে পালিয়ে ইসরায়েলে বসবাস করছেন। মি শোরের দলের যুক্তি – মস্কোর সাথে সুসম্পর্ক রাখলে জ্বালানি সংকটের সুরাহা হবে।
ট্রান্সনিস্ট্রিয়া, বিচ্ছিন্ন অঞ্চল
মলদোভা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অঞ্চল ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় অনেক দিন ধরেই রুশ সৈন্য মোতায়েন রয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরপরই ১৯৯০ সালে ইউক্রেনে সীমান্ত সংলগ্ন ছোট এই অঞ্চলটি মলদোভা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
স্বল্প সময়ের একটি যুদ্ধের পর ১৯৯২ সারে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়, এবং তখন থেকেই রুশ ভাষাভাষী এই অঞ্চলে দেড় হাজার রুশ সৈন্য মোতায়েন রয়েছে।
স্বঘোষিত এই স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কখনই পায়নি ট্রান্সনিস্ট্রিয়া। কিন্তু রাশিয়ার কাছে থেকে অঞ্চলটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য পাচেছ।
২০০৬ সালে স্বাধীনতার প্রশ্নে এক গণভোটে এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক বাসিন্দা পক্ষে ভোট দেয় এবং একইসাথে তারা রাশিয়ার সাথে যোগ দেওয়ার পক্ষে মতামত দেয়। যদিও মলদোভা কখনই ঐ গণভোটের স্বীকৃতি দেয়নি।
“যতদিন ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক থাকবে, মলদোভায় উত্তেজনাও অব্যাহত থাকবে,” বলেন বিবিসির সংবাদদাতা পল কারবি।
“এক বছর আগে যখন রুশ বাহিনী ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে অভিযান চালায় তখন আশংকা দেখা দেয় যে তারা হয়তো বন্দর শহর ওডেসা এবং ট্রান্সনিস্ট্রিয়া পর্যন্ত পুরো উপকূল দখল করার চেষ্টা করবে।“
“কিন্তু তা তারা পারেনি। কিন্তু মলদোভার নেতার মুখ থেকে যে আশংকার কথা শোনা যাচ্ছে তার সঙ্গে ২০২২ সালের এপ্রিলে ঘটা কিছু ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে,” বলেন পল কারবি।
গত বছরের এপ্রিলে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় পরপর বেশ কটি রহস্যজনক বিস্ফোরণ হয়। ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার প্রশাসন সেসময় বলে নিরাপত্তা সদর দপ্তর, একটি সামরিক ইউনিট এবং রেডিও টাওয়ারে টার্গেট করা হয়েছে।
ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার প্রশাসন সেসময় ইউক্রেনীয় “অনুপ্রবেশকারীদের” ঐ বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করে।
কিন্তু ইউক্রেনের সরকার তখন পাল্টা দাবি করে মলদোভাকে অস্থিতিশীল করতে রাশিয়ার বিশেষ বাহিনী এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
এ সপ্তাহে, রুশ সরকারি কর্তৃপক্ষ দাবি করে “ইউক্রেনীয় নাশকতাকারীরা” রুশ সেনাবাহিনীর পোশাক পরে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় হামলার পরিকল্পনা করছে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ায় মোতায়েন রুশ সৈন্যদের জন্য ইউক্রন হুমকি তৈরি করেছে।
“ইউক্রেনের যে কোনো উসকানির উপযুক্ত জবাব দেবে রাশিয়া,” এক বিবৃতিতে বলে রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তর।
মলদোভার সরকার রুশ এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানায়।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করেন না যে মলদোভার ওপর রাশিয়া সরাসরি কেনো সামরিক অভিযান চালাবে।
“যুদ্ধের শুরুর দিকে অনেক সামরিক বিশ্লেষক বলেছিলেন ট্রান্সনিস্ট্রিয়াকে ভিত্তি করে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চল দখলের চেষ্টা করবে রাশিয়া,” বলেন লন্ডনের দৈনিক ফাইনানশিয়াল টাইমসের ইউরোপ সংবাদদাতা রাফায়েল মাইন্ডার।
“কিন্তু রুশ সৈন্যরা এখন ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বে চাপের মধ্যে আছে, পিছু হটছে। ফলে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে রসদ নিয়ে গিয়ে মলদোভা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঐ অঞ্চলকে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের সম্ভাবনা খুবই কম এখন।“
বিশেষজ্ঞরা বলছেন মলদোভার মূল সংকট এখন আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা।
“মলদোভার এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়া ,” বলেন মলদোভার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডেনিস সেনুসা।
সংবাদ বিষয়ক ওয়েবসাইট রিডল ডট কমকে তিনি বলেন, “রাশিয়া যদি তাদের স্বল্পমেয়াদী কৌশল কাজ লাগাতে ব্যর্থও হয়, তাহলেও গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে দীর্ঘ-মেয়াদী কৌশলে তারা সাফল্য পেতে পারে। ব্যালট বাক্সেই সেই সাফল্য তারা পেতে পারে। “
২০২৩ সালে মলদোভাতে স্থানীয় নির্বাচন, ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।