রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বঙ্গবন্ধু হলে এক শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে তিন ঘণ্টার বেশি নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনের শিকার ওই শিক্ষার্থী ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়িতে চলে গেছেন। সেখান থেকে তিনি কুরিয়ারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। মারধরের পর ওই শিক্ষার্থীর ডেবিট কার্ড থেকে ছাত্রলীগের দুই নেতা ৪৫ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন বলেও তিনি অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন। তবে ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি এমন কিছু ঘটেনি। তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ছাত্রের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থাকায় তারা সেটির মিমাংসা করেছিলেন।
অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর নাম আল-আমিন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলায়। গত ১৭ আগস্ট তার চতুর্থ বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয়। ওইদিনের পরীক্ষা শেষে তাকে নির্যাতন করা হয়। পরে তিনি আর পরীক্ষা না দিয়েই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান।
ভুক্তভোগী আল আমিনের অভিযোগটি বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দপ্তরে পৌঁছেছে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রশাসন।
বিষয়টি জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, আল আমিন নামে এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা পয়সা নেওয়ার অভিযোগ তুলে কুরিয়ারে ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ পাঠিয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর তিনজন সহকারী প্রক্টরকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে।
লিখিত অভিযোগে আল-আমিন বলেছেন, তিনি ১৭ আগস্ট পরীক্ষায় অংশ নেন। বিকেল সাড়ে চারটায় পরীক্ষা শেষে বের হওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও মতিহার হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা তাকে রবীন্দ্রভবন থেকে বঙ্গবন্ধু হলের ৩৩১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে মুমিনুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ ওরফে শশী, তাকি আহমেদসহ অনেকে আসেন।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, মার্কেটিং বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মুমিনুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ শশী ও তাকি আহমেদের সঙ্গে কয়েক মাস ফ্রিল্যান্সিং ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’-এর কাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু মনোমালিন্য হওয়ায় বছরখানেক আগে তিনি কাজ ছেড়ে দেন। এ কাজের জন্য তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তিপত্র ছিল না।
অভিযোগপত্রে আল-আমিন আরো বলেন, মুমিনুর তার মাথায় দুই লিটার পানির বোতল ও লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। তিনি একপর্যায়ে অচেতন হয়ে যান। এ সময় তার মুঠোফোন থেকে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেন তারা। জ্ঞান ফেরার পর রাত আটটার দিকে জোরপূর্বক তার ডেবিট কার্ড নিয়ে গিয়ে ৪৫ হাজার টাকা তোলেন সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও ভাস্কর সাহা। এসময় মুমিনুর ও তার অনুসারীরা তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন।
আল-আমিন উল্লেখ করেন, মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। তারা জোরপূর্বক মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেন এবং সেটির ভিডিও ধারণ করেন। তারা হুমকি দিয়ে বলেন, তাদের কথার বিপক্ষে কোনো কথা বললে এবং কোনো পদক্ষেপ নিলে তাকে মেরে ফেলা হবে। তাই তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য তারা যা বলেছেন, তাই করেছেন তিনি।
এবিষয়ে অভিযোগকারী আল-আমিন বলেন, তাদের কাছে আমার পরীক্ষার প্রবেশপত্র আছে। প্রাণ ভয়ে আছি সেজন্য রাজশাহী যেতে পারছি না। এজন্য কুরিয়ারের মাধ্যমে অভিযোগ পাঠিয়েছেন।
তবে অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা। তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি করেছে আল-আমিন। তাই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ভয়ে মিথ্যা অভিযোগ করছে।
এবিষয়ে ফয়সাল আহমেদ শশী বলেন, ‘আমি একটি অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। সেখানে ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরে কাজ করত আল-আমিন। তাকে মমিনুর কাজ শিখিয়েছিল। তার সঙ্গে লিখিত কোনো চুক্তি হয়নি, কথা ছিল দুই বছরের আগে কাজ ছাড়তে পারবে না। আল আমিন সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চাকরি ছেড়েছে। পাশাপাশি আমাদের ক্লায়েন্টের ডাটা চুরি করে সে আমাদের কাছ থেকে তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছে এতে ব্যবসায়িকভাবে ১০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে আমার। সেদিন বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে বসা হয়েছিল। মারধর টাকা নেওয়ার ঘটনাটি তিনি জানেন না বলেও জানান।
ছাত্রলীগকে জানানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রথমে টুকিটাকিতে কথা বলছিলাম। সেখানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আল আমিনের এক বন্ধু তাকে বিষয়টি জানালে সাধারণ সম্পাদক মিমাংসা করতে এগিয়ে আসেন।
আরেক অভিযুক্ত মুমিনুর রহমান বলেন, আল-আমিনসহ আরও কয়েকজনকে তাদের দুরবস্থার সময় চাকরি দিয়েছিলাম। এক-দেড় বছর চাকরি করার পর আল-আমিন বিসিএস পরীক্ষা দেবে বলে চলে যান। আমাদের তথ্য নিয়ে তারা কয়েকজন মিলে আরেকটি কোম্পানি খোলেন। আমাদের কোম্পানির ক্লায়েন্টদের তারা সরিয়ে নিয়েছে। এতে আমরা কোটি কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। তিনি আইনি পদক্ষেপ নিবেন বলেও জানান।
টাকা নেওয়া অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত বলেন, টাকা নেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক ঝামেলা হয়েছিল। মমিনুর আমাকে জানালে আমি সাধারণ সম্পাদক রুনুকে বলি। তিনি মিমাংসা করে দেন। মারধর-টাকা নেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুকে একাধিকবার কল করা হলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।