সুখ জিনিসটা মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুঃখের সাগরে ভেসে বেড়ানো মানুষের জীবনে এক চিলতে সুখ এনে দিতে পারে অকল্পনীয় পরিবর্তন। আবার লাগাতার দুঃখ-বেদনা নষ্ট করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। সুখের সঙ্গে দুঃখের সম্পর্ক থাকলেও স্বর্গ থেকে আসে সুখ—এমনটিই ধারণা সব মানুষের। সবাই যেমন দুঃখ ভোগ করে না, তেমনি সবাই চিরসুখীও নয়। কারা সুখী আর কারা দুঃখী—এই প্রশ্নের উত্তর বের করার বিষয়টি এখন সময়ের দাবি। অবশ্য জাতিসংঘ বিগত ২০১২ সালের পর থেকে সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করে আসছে। সেই সুবাদে প্রতি বছর ২০ মার্চকে বিশ্ব সুখ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
এই তালিকায় চলতি বছরে (২০২৩) প্রথম স্থান অর্জন করেছে ফিনল্যান্ড। জাতিসংঘের সুখী দেশের এই তালিকায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪তম হলেও এ বছর তা ১১৮তম স্থানে রয়েছে। হিসাব করে বললে বহুগুণে কমেছে বাংলাদেশের সুখ। সর্বমোট ২৩ ধাপ পিছিয়েছি আমরা। দুঃখের বিষয় হলো, তালিকার তলানিতে থাকা ২০ দেশের মধ্যে ঠাঁই হয়েছে বাংলাদেশের। আমাদের সুখে কেন এই ভাটা? চলুন খুঁজি সেই উত্তর। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর অসহনীয় মাত্রায় দেশে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। অস্বাভাবিক এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে দিশেহারা দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ভোগব্যয় বাড়লেও সম্প্রসারিত হয়নি মানুষের আয়ের উৎস। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ দিয়ে চলছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। কথায় আছে, পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি। অথচ এর উলটো চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। এখানকার বাজারের সার্বিক অবস্থা দেখে বলা চলে, পেটে অশান্তি তো দুনিয়া অশান্তি। চাল, ডাল, তেলসহ সব পণ্যের দাম আকাশছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নামার দরুন পেট পুরে ভাত খেতে পারছে না দেশের নিম্ন আয়ের কোটি মানুষ। চাপা আর্তনাদ আর কত? সেই প্রশ্নেরও উত্তর মেলা এখন বড় দায়!
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরা যায়নি বলে একবেলা না খেয়ে থাকছে দেশের অনেক দরিদ্রপীড়িত পরিবার। আবার দুবেলা দুমুঠো খেলেও তাদের ঐ খাবার পান্তা ভাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য কারণে অসহনীয় মাত্রায় বাড়ছে পণ্যসামগ্রীর দাম। তদুপরি এর ওপর নেই কার্যকর বাজার মনিটরিং। আমাদের উন্নয়নের অলংকার যেন হারিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ পালন করতে পারে সেই অলংকারের ভূমিকা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), পিপিআরসি ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে দেশে দরিদ্র বেড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। তাদের মতে, দারিদ্র্যের এই হার করোনা-পূর্ব ২১ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, এই হার অনেক কম। কিন্তু সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছে এর সমর্থনে কোনো তথ্য নেই। ২০২০ সালের অক্টোবরে বিবিএসের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে গেছে। ২০২৩ সালে এসে এই কম আয়ের ঘাড়ে চেপে বসেছে লাগামহীন বাজারব্যবস্থা। পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে একাকার হয়ে গেলেও প্রসারিত হয়নি মানুষের আয়ের উৎস। শুধু যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি কেড়ে নিয়েছে আমাদের সুখ, তা কিন্তু নয়। গত এক বছরে সীমান্তে চোরাচালান, মাদক সরবরাহসহ বেশ কয়েকটি বিষয় অসুখীর তালিকায় আমাদের স্থান তৈরির জন্য দায়ী। সীমান্তে চোরাচালান, মাদক কারবার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা প্রশংসাযোগ্য হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
ফলস্বরূপ, সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের এই অবস্থান। ১১৮তম অবস্থানে থেকে আমরা যে কত সুখী, তা আর ভাষায় প্রকাশ করতে চাই না। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্যে ভোগান্তি কমিয়ে আনার পাশাপাশি বাকি সব বিষয় মাথায় রেখে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য কাজে লেগে পড়ার এখনই সময়। এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। নয়তো বেঁচে যাওয়া সুখটুকু থেকেও বঞ্চিত হবে শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতি। দেশের সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে আগের মতো জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণে পাশাপাশি বাড়াতে হবে সব সেক্টরে সেক্টরভিত্তিক নজরদারি। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত রূপে ফিরতে পারব আমরা।