দেশে এখন আলোচনার শীর্ষে আছে কোটা বিরোধী আন্দোলন, প্রশ্নফাঁসের হোতা আবেদ আলী এবং কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীদের দুর্নীতি নিয়ে । সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল বা হ্রাসের যে আন্দোলন চলছে , আমি তার বিরোধীতা করি কিংবা সমর্থন করি। কিন্তু কেন ? সেই ভাবনাটাই আমি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার ভাবনার সাথে অনেকর দ্বিমত থাকতে পারে আবার অনেকে একমতও পোষণ করতে পারেন। তবে সে যাই হউক আপনার অবশ্যই বিচার বিশ্লেষণ করে সত্যিটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিবেন। কোটা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌক্তিক পরিমাণ মানুষ যেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও অনগ্রসর গোষ্ঠীর অগ্রসরতার জন্য উচ্চ শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে কিছু সংরক্ষিত আসন থাকে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। ভারতে মোট ৪ ধরণের কোটা রয়েছে; উপজাতি কোটা, বিভিন্ন জাত ভিত্তিক কোটা, অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য কোটা এবং বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু কোটা। উপজাতি কোটা ৭.৫ শতাংশ, জাতভিত্তিক কোটা ১৫ শতাংশ এবং সংখ্যালঘু ও অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য ২৭ শতাংশ কোটা ভারতে সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় বিদ্যমান। পাকিস্তানের কোটা পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার ভিত্তিতে। বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংখ্যার উপর নির্ভর করে সেই অনুপাতে কোটা সুবিধা প্রদান করা হয় সেখানে। পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে সমগ্র দেশ থেকে মাত্র ৭.৫ শতাংশ চাকরি মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। নেপালের সরকারি চাকরিতে কোটা দুই ভাগে করা আছে। একটি ৫৫ শতাংশ সাধারণ কোটা এবং অন্যটি ৪৫ শতাংশ সংরক্ষিত কোটা। সংরক্ষিত কোটার মধ্যে নারী, উপজাতি, মধেশি, দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাখা হয়েছে। উন্নত রাষ্ট্র কানাডায়ও রয়েছে কোটা তবে সে কোটা প্রয়োগ হয় প্রকৃত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীদের জন্য। কানাডায় মূলত চারটি শ্রেণির জন্য কোটা প্রযোজ্য। চারটি শ্রেণি হচ্ছে নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্তদেশগুলো ২০১২ সালে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে যার মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে নন-এক্সিকিউটিভ চাকরিগুলোতে যেন ৪০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে কোটা পদ্ধতিকে বলা হয় অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন পলিসি। নীতির অধীনে দেশটিতে কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপ্যানিক জাতি, নেটিভ আমেরিকানদের চাকরি ও যথাযথ শিক্ষার বিষয়টি সুরক্ষিত করা হয়। এই নীতি সরকারি ও বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য।এছাড়াও কোটা রয়েছে চীন, জাপান, মালয়শিয়া প্রভৃতি দেশে।
আমি যতটুকু জানি, কোটায় চাকরি পেতে হলেও একজন কোটাপ্রার্থীকেও মেধার যোগ্যতায় লিখিত পরীক্ষায় উর্ত্তীন হতে হয়। লিখিত পরীক্ষায় উর্ত্তীন হতে পারলেই তবে কোটার সুবিধা পাওয়া যায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এবং পোষ্য কোটায় এই পর্যন্ত বাংলাদেশে কয়জন বিসিএস ক্যাডারে বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে নিয়োগ পেয়েছে? আমি যেটা জেনেছি যে এই সংখ্যাটা অতি নগণ্য। এতোই নগণ্য যে সব কয়জনকে যোগ করলেও চাকরির এক শতাংশও হবে না। মুক্তিযোদ্ধা ও পোষ্য কোটায় লোক পাওয়া যায় না, এই কারণে কোটা খালি থাকে। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা ও পোষ্য কোটার কারণে যে কেউ খুব একটা বঞ্চিত হচ্ছে সেটা সত্যি নয়। এই কোটাটা কার্যত কারো স্বার্থই বিঘ্নিত করে না। বিশেষ ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও পোষ্য কোটার উপর এতো ক্ষোভ কেন আপনাদের? ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘নাতিপুতি কোটা’! বিবৃতি, সাক্ষাৎকার এসব দিয়ে নানা কথার প্যাঁচ কষে যে কথাটা বলতে চান সেটা হচ্ছে যে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের রাষ্ট্রে কোনো বিশেষ মর্যাদা বা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার হকদার নন। আপনাদের এসব কথার কী অর্থ করবো? যদি এমন হতো যে মুক্তিযোদ্ধা কোটার কারণে শত শত চাকরি ওদের ছেলেমেয়েরা বা নাতি-পুতিরা নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে বুঝতাম যে স্বার্থ রক্ষার জন্য বলছেন। সেটা তো নয়।
কোটা বিরোধী আন্দোলন না করে একটা কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সেইসাথে নতুন নতুন কর্মসংস্থান ও শূন্য আসনগুলোতে দ্রুত নিয়োগের আন্দোলন করতে পারলেই অনেক ভালো হতো।কোটা বিরোধী আন্দোলনের অনেকেই আছেন যারা আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে পারেন না, যারা নারী শিক্ষাকে পশ্চাতে রেখে নারীদেরকে একটি গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চান। কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেতেন যদি তারা ঘুষ, দুর্নীতি, টাকা পাচার, ঋণখেলাপী, প্রশ্নফাঁস, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির মতো সংকটগুলি নিয়ে একটা জোড়ালো আন্দোলন গড়ে তুলেতে পারতেন। তাতে সমগ্র দেশবাসীই এর সুফল ভোগ করতেন।
অনেকে বলেন যে অনেক নাকি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আছে। বলি, তার জন্যে মুক্তিযোদ্ধা কথাটা আমরা ভুলে যাবো? কিছু প্রতারক ধরনের লোক জাল-জালিয়াতি করে ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে চেষ্টা করে, ওদের ধরে জেলে পাঠানো দরকার, শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ওদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার সম্মান শেষ হয়ে যাবে? চোরের জন্যে মুক্তিযোদ্ধা কথাটা ভুলে যাবো? কিছু লোক প্রশ্ন ফাঁস করে, সেই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বিসিএস পাস করে, তার জন্য বিসিএস তুলে দিবেন? পুলিশের কিছু লোক চুরি করে, পুলিশ বাহিনী তুলে দিবেন? আর্মির জেনারেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, আর্মি তুলে দিবেন ? টেলিভিশনে দেখলাম কেউ কেউ বলছেন যে, ‘মুক্তিযোদ্ধারা কি কোটা চেয়েছিলেন?’ তাদেরকে বিনযের সাথে বলছি মুক্তিযোদ্ধারা ব্যক্তিগত সুবিধা চাইবেন কেন? ১৯৭১ যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ব্যক্তিগত সুবিধার জন্যে যারা যুদ্ধে গিয়েছিল ওরা তো রাজাকারের যোগ দিয়েছে। রাজাকাররা বেতন পেতো, ভাতা পেতো, লুটের মাল ভাগ পেতো। লোভ করেছে রাজাকাররা। মুক্তিযোদ্ধারা তো জীবন দিতে গেছে দেশের জন্যে। জি। প্রাণ দিতে গেছে, মরতে গেছে। জাহানার ইমামের সেই কথাটা জানেন না? তার পুত্র যখন বলছে যুদ্ধে যাবে, তিনি কী বলেছেন? জানেন সেকথা? না জানলে খুঁজে বেড় করেন, জেনে নিন। সেকথা বলতে আমার বুক ভেঙে যায়। কিন্তু সেই কথাটা একদম বর্ণে বর্ণে সত্যি। কল্পনা করুন পরিস্থিতিটা। একটা অন্ত্যন্ত শক্তিশালী সুসজ্জিত বাহিনী আমাদের দেশ আক্রমণ করেছে। বিশাল সে বাহিনীÑ ষোলোই ডিসেম্বরে আমাদের হাতে বন্দীই হয়েছিল প্রায় এক লাখ। ওদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র-চীনের অস্ত্র, আমেরিকার অস্ত্র, ব্রিটিশ হাতিয়ার, দেশে তৈরি অস্ত্র। ট্যাঙ্ক কামান বিমান জাহাজ কোনো কিছুর কমতি নেই। একঝাঁক জেনারেল পরিচালনা করছে সেই আক্রমণ। একজন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক ওর মাকে বলছে যুদ্ধে যাবে এই বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে। ওদেরকে আপনি কী বলবেন? এঞ্জেল? পাগল? বেওকুফ? না, ওরা দেশের জন্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছে লিটারেলি। কোনো মুক্তিযোদ্ধাই ব্যক্তিগত লাভের জন্যে যুদ্ধে যায়নি। লোভীরা পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিল, আর যুদ্ধে গেছে দেশপ্রেমিকরা। আর দেশপ্রেম কী জিনিস? এই প্রেম সেই প্রেম না। দেশপ্রেম হচ্ছে এমন একটা পরীক্ষা যেটাতে পাস মার্ক হচ্ছে ১০০তে ১০০- ৯৯ পেলেও ফেইল। এই পরীক্ষায় পাস করেছে কেবল আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। এদেশের আর কেউ না। আমার সারা জীবনের আফসোস, কেন আমি আরও কয়েক বছর আগে জন্মালাম না, এই পরীক্ষাটায় অংশ নিতে পারলাম না। ওরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। এমনকি যে চোরটা জেলের তালা ভেঙে যুদ্ধে গিয়েছিল, সেও আমাদের যুদ্ধে না যাওয়া সবচেয়ে মেধাবী ব্যক্তিটির চেয়ে উত্তম। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় সেই চোরটিও পাস করেছে, সেই পরীক্ষায় আমাদের বিপক্ষে থাকা পণ্ডিতরাও ফেইল, অথবা সেইসব উচ্চশিক্ষিত মেধাবীরা যারা একরকম নিরাপদ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল। আপনি আমাদের সেসব প্রিয়দের চেয়ে প্রিয়তম মানুষগুলোর ত্যাগের কী প্রতিদান দেবেন? সামান্য কয়েকটা বিসিএস চাকরি? শোনেন। আপনি যদি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্ব না বুঝে থাকেন, আপনার জীবনে ওদের অবদান অনুধাবন না করতে পারেন, আপনি হয় মূর্খ অথবা আপনি মন্দপক্ষ।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা বা পোষ্য কোটা, আপনারা যাকে বলছেন নাতিপুতি কোটা, এটা হচ্ছে আমাদের সেইসব পাগল দিওয়ানা সর্বস্বত্যাগী দেশপ্রেমিকদের জন্যে এই জাতির অতি সামান্য একটি নৈবেদ্য মাত্র। আপনি ব্যক্তিগত স্বার্থে এর বিরোধ করবেন? তাও বুঝতাম যদি এই কোটায় কারো ক্ষতি হতো বা কাউকে বঞ্চিত করা হতো। সেটাও তো হচ্ছে না। পিএসসিকে জিজ্ঞাসা করেন, ওরা আপনাকে জানাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এযাবৎ কয়জনের চাকরি হয়েছে। তিরিশ পারসেন্ট শুনতে ইয়ে শুনায় বটে, কিন্তু কার্যত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছে অল্প কয়েকজন, অনুল্লেখযোগ্য সংখ্যা, এক পারসেন্টেরও কম।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা কেন তুলে দিবেন? পরে হয়তো মুক্তিযুদ্ধটাকেই তুলে দেওয়ার আন্দোলন করবেন মতলবটা কী? আন্দোলনের সকলের মতলব জানি না, অনেকেই হয়তো স্পষ্ট ধারণা নেই বিধায় আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। কেউ কেউ গণতন্ত্রের সংগ্রামের অংশ বিবেচনা করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। কিন্তু এই আন্দোলনের নেতৃত্বে কিছু ক্যারেক্টারকে আমরা দেখেছি, চিনি ওদের, ওরা মুক্তিযুদ্ধের গরিমাকে ম্লান করার উদ্দেশ্যে আন্দোলনটা টেনে নিচ্ছে। জানুন, তথ্য দেখুন, এরপর একবার আমার পতাকার দিকে তাকান, বুকে হাত দিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের দুইটা লাইন গেয়ে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলুন। বলুন, আপনি আমাদের জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ, এর গরিমা ম্লান করতে চান? আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আন্দোলনটা কি কোটা বিরোধী নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ?