নির্দিষ্টকরণ বিল পাসের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে। দেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এই বাজেট নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন কাল শুক্রবার থেকেই কার্যকর হবে। এরআগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘নির্দিষ্টকরণ বিল-২০২২’ পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে কন্ঠভোটে সর্বাধিক ভোটে কোন পরিবর্তন ছাড়াই তা পাস হয়।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) বিকেলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের চতুর্থ জাতীয় বাজেট পাসের কার্যক্রম শুরু হয়। অর্থমন্ত্রী গত ৯ জুন ‘কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামের এই বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গত ১৩ জুন সম্পুরক বাজেট পাসের পর ১৪ জুন থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গত ২৯ জুন এই আলোচনা শেষ হয়। প্রায় ৩৯ ঘণ্টার এ আলোচনায় সরকার ও বিরোধী দলের মোট ২২৮ জন সংসদ সদস্য অংশগ্রহণ করেন
সরকারি ও বিরোধী দলের অধিকাংশ সদস্যের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বাজেটের ওপর ৫৯টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে ৬৬৪টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনা হয়। সরকার ও বিরোধী দলের হুইপের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে ৪টি মঞ্জুরি দাবি আলোচনা হয়। এগুলো হলো নির্বাচন কমিশন, স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ চারটি মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরী দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম, মজিবুল হক, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, বেগম রওশন আরা মান্নান, পীর ফজলুর রহমান, রুস্তম আলী ফরাজী, পনির উদ্দিন আহমেদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, বিএনপির রুমিন ফারহানা, হারুনুর রশীদ, মোশাররফ হোসেন, গণফোরামের মোকাব্বির খান, স্বতন্ত্র এমপি রেজাউল করিম বাবলু।
আলোচনা শেষে মঞ্জুরি দাবিগুলো কণ্ঠভোটে সংসদে গৃহীত হয়। এরপর অর্থমন্ত্রী সর্বোচ্চ ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫১ কোটি ৮১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ব্যয়ের অনুমোদন নিতে ‘নির্দিষ্টকরণ বিল-২০২২’ পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরে কণ্ঠভোটে তা পাস হয়।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদেসহ সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়িয়ে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বাজেট বাস্তবায়নের যাত্রাকে স্বাগত জানান।
প্রসঙ্গত, নির্দিষ্টকরণ বিলটি মূলত গ্রস (মোট) বাজেট যা-, যা সংযুক্ত তহবিলের উপর দায়, যা ২০২৩ সালের সমাপ্য অর্থবছরে যেই সব ব্যয় হতে পারে তা নির্বাহের জন্য এই আইনের তফসিলের ২ এ বর্ণিত কার্যাবলীর বিপরীতে কলাম ৫ এ উল্লিখিত ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫১ কোটি ৮১ লাখ ৯৭ হাজার টাকার অনধিক পরিমাণ অর্থ সংযুক্ত তহবিল থেকে দেয়া ও ব্যয় করা হতে পারে। এটি বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও অন্যান্য খাতে বাজেটে সরকারের অর্থ বরাদ্দের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এই বাজেট অতিরিক্ত অর্থ কখনো ব্যয় হয় না, যা বাজেটের আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে হিসাব মেলানো হয়। এ বাধ্যবাধকতার কারণে এবারের বাজেটেও দুই লাখ ৫ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে নির্দিষ্টকরণ বিলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত: অর্থমন্ত্রী গত ৯ জুন ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার যে বাজেট উত্থাপন করেছেন, সেটাই ব্যয় হবে। সেটাই আগামী অর্থবছরের নিট বাজেট। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি।
নতুন অর্থ বছরের বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। বরাবরের মতো প্রধান আয়ের খাত হিসেবে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ববহির্ভূত আয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে পরিচালন বা আবর্তক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৩০ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের জন্য বৈদেশিক উৎস থেকে (অনুদানসহ) পাওয়া যাবে এক লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হবে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে এক লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ ৪০ হাজার এক কোটি ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে ৫ হাজার এক কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরের জন্য জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির আকার ছিলো ৩৬ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা।