আসন্ন পবিত্র কোরবানির ঈদে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ পশু প্রস্তুত আছে। এর প্রায় ৭০ শতাংশ গরু। গরুর বয়স ন্যূনতম দুই বছর হলে সেটি কোরবানির জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে গরুর দাঁত দেখে বয়স যাচাই করে নিতে হয়। গরুর মুখের নিচের পাটিতে যদি দুধ দাঁতের পাশাপাশি সামনে অন্তত দুটি কোদালের মতো স্থায়ী দাঁত থাকে, তাহলে বুঝতে হবে গরুটি কোরবানির উপযুক্ত। বাংলাদেশে গরুর কোনো স্বীকৃত মাংসাল জাত নেই। বিশ্বে উন্নতমানের কিছু মাংসাল জাতের গরু রয়েছে, এ ধরনের মধ্যে অ্যাংগাস, ব্রাহমা, ব্র্যাংগাস, ডেভন, হেয়ার ফোর্ড, পোল্ড হেয়ার ফোর্ড অন্যতম। তবে বর্তমানে পাঁচ ধরনের স্থানীয় দেশি জাতের গরু পাওয়া যায় : রেড চিটাগাং ক্যাটল, পাবনা ক্যাটল, নর্থ বেল গ্রে, মুন্সিগঞ্জ ক্যাটল বা মিরকাদিমের গরু।
এসব গরুর চাহিদার কথা মাথায় রেখে বহু খামারি গরু মোটাতাজা করেন। পেশাদার সৎখামারিরা সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদি পশু হষ্ট-পুষ্ট করেন। সবাই চান সামর্থ্য অনুযায়ী হষ্ট-পুষ্ট মোটাতাজা একটি গরু কোরবানি দেবেন। অনেক সময় গরু মোটা পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত মাংস পাওয়া যায় না। কারণ, কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজা করা হয়। বেশি মুনাফার আশায় স্টেরয়েড ব্যবহারসহ নানাভাবে গরু মোটাতাজা করা হয়। সেসব গরুর মাংস বিপজ্জনক, স্বাস্থ্যঝুঁকি অনিবার্য। তাই কোরবানিতে আপনার পছন্দের গরুটি ঘরে আনার আগে সেই মোটাতাজা গরু সম্বন্ধে ধারণা রাখা জরুরি। তা না হলে পশু কিনে আপনি ঠকে যেতে পারেন। আসুন এ বিষয়ে চোখ বোলানো যাক:
১. আঙুলের চাপে মাংস দেবে যাওয়া : কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর গায়ে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ঐ স্থানের মাংস দেবে যাবে এবং দেবে যাওয়া অংশ আবার স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে। এসব গরুর গা ‘পানি নামা’ রোগীর শরীরের মতো ফুলে থাকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে বা স্বাভাবিকভাবে মোটা করা গবাদি পশুর ক্ষেত্রে দ্রুতই মাংস স্বাভাবিক হয়।
২. ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস : কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরু দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। একটু হাটলেই হাঁপায়, খুবই ক্লান্ত দেখায়। শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের সময় যদি শব্দ হয়, তাহলে এ ধরনের গরু না কেনাই ভালো।
৩. রানের মাংস নরম থাকে : কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর রানের মাংস স্বাভাবিক গরুর রানের মাংসের চেয়ে অনেক নরম থাকে।
৪. লালা বা ফেনা থাকা : কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর মুখে লালা বা ফেনা থাকে। যেসব গরুর মুখে কম লালা বা ফেনা থাকে, সে গরু কেনার চেষ্টা করুন। এগুলো কৃত্রিম উপায়ে মোটা করা পশু নয়।
৫. খুব শান্ত/ক্লান্ত দেখায় : সুস্থ গরু একটু চটপটে থাকে। কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরু শরীরে পানি জমার কারণে নড়াচড়া কম করে। এক জায়গায় বসে থাকে। এসব ক্ষেত্রে গরুকে বসা থেকে উঠিয়ে হাঁটিয়ে দেখতে হয়।
৬. খাবার : গরুর মুখের সামনে খাবার ধরলে যদি নিজ থেকে জিহ্বা দিয়ে খাবার টেনে নিয়ে খেতে থাকে তবে বোঝা যাবে গরুটি সুস্থ। যদি অসুস্থ হয়, তবে সে খাবার খেতে চায় না।
৭. নাকের ওপরটা ভেজা : সুস্থ গরুর নাকের ওপরটা ভেজা ভেজা থাকে। সুস্থ গরুর পিঠের কুঁজ মোটা ও টান টান হয়।
৮. তাপমাত্রা : গরুর শরীরে হাত দিয়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের (৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) চেয়ে বেশি মনে হলে বুঝতে হবে গরুটি অসুস্থ।
৯. হাড় বেরিয়ে পড়া : যেসব গরুর চেহারা স্বাভাবিক উশকোখুশকো এবং চামড়ার ওপর দিয়ে হাড় বেরিয়ে থাকে। সেগুলো সুস্থ ও প্রাকৃতিকভাবে মোটা করা গরুর লক্ষণ। বেশি চকচক করা গরু বা ছাগলের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকে।
১০. নাকের ওপরের অংশ ভেজা : সুস্থ গরুর নাকের ওপরের অংশ ভেজা বা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা থাকবে। অন্যদিকে অসুস্থ গরুর নাক থাকবে শুকনা।
ওপরের এই বিষয়গুলো লক্ষ রাখলে অবৈজ্ঞানিক/কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরু এড়ানো সম্ভব হবে। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ত্রস্টরয়েড দিয়ে মোটাতাজা করা গবাদিপশুর মাংস অত্যন্ত বিপজ্জনক ও স্বাস্থ্যঝুঁকি অনিবার্ষ।
অনেক সময় দেখা যায়, গরুর মাংস খেয়ে অনেকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, এর পেছনে কারণ এটাই। এ জাতীয় ওষুধ অতিরিক্ত মাত্রায় দিলে গরুর কিডনি ও যকৃত্ অকার্যকর হয়ে যায়। এতে শরীর থেকে পানি বের হতে পারে না, পানি সরাসরি গরুর মাংসে চলে যায়। এজন্য গরুকে মোটা, তুলতুলে ও নাদুস-নুদুস দেখায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটাতাজাকরণের এসব ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয় না, গরুর দেহের মাংসে রয়ে যায়। এসব মাংস যখন মানুষ খায়, তখন ঐসব ওষুধের প্রতিক্রিয়া মানুষের শরীরেও দেখা দেয়। স্টেরয়েড ওষুধ মানবদেহের কিডনি, ফুসফুস, লিভার, হূিপণ্ডকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রন্ত করে। মানবদেহের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। ফলে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অনিদ্রা, অস্থিরতাসহ নানা রোগের সৃষ্টি করে। এতে মানুষের শরীরে পানি জমে যাওয়া, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, মূত্রনালি ও যকৃতের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। হরমোন দিয়ে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খেলে মানবদেহে এসব হরমোন মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মানবদেহে প্রতিনিয়ত প্রকৃতিগতভাবে হরমোন তৈরি হচ্ছে।
ক্ষতিকর হরমোন পরোক্ষভাবে শরীরে ঢুকলে এই হরমোনগুলো মানব শরীরে নানা রোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে অল্প বয়সি বা ছোট শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হরমোন বা স্টেরয়েড শিশুদের মস্তিষ্ক ও যৌনাঙ্গ গঠনে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে মাংসের মাধ্যমে গ্রহণ করা স্টেরয়েড নানা অসুখ ডেকে আনতে পারে। এসব ক্ষতিকর ওষুধ মানব শরীরে জমা হয়ে টিউমার, ক্যানসার, কিডনি নষ্ট করার মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে নারীদের গর্ভধারণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই যতটুকু সম্ভব দেখে-শুনে আসন্ন পবিত্র কোরবানিতে হষ্ট-পুষ্ট গবাদিপশু কিনি ও স্বাস্থ্যসম্মত মাংস (কোমলতা, স্বাদ, রসালো, চর্বিহীনতা, পুষ্টির পরিমাণ, নিরাপত্তা এবং সুবিধা) গ্রহণ করে দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করি।