ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর ক্ষেত্রে সাহস ও শক্তির জায়গা কী—এমন প্রশ্নের জবাবে একদা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উদ্ধৃতি করেছিলেন রুশ জার, কংগ্রেস পোল্যান্ডের সম্রাট ও ফিনল্যান্ডের গ্র্যান্ড ডিউক তৃতীয় আলেকজান্ডারের উক্তি—‘রাশিয়ার শক্তি, ক্ষমতার উৎস নিদেনপক্ষে দুটি—রাশিয়ান সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী।’ রাশিয়ান বাহিনী নিয়ে কথা বলার সময় পুতিনকে সব সময়ই আত্মপ্রত্যয়ী দেখা যায় বটে, কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান বাস্তবতা কী বলছে? আমরা দেখছি, চলমান সংঘাতে পুতিনের সামরিক বাহিনী লক্ষ্য অর্জনে অনেকাংশে ব্যর্থ। বেশ খানিকটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে রুশ বাহিনী। আশ্চর্যজনকভাবে, পুতিনবাহিনীর সামর্থ্যের ঘাটতিও দৃশ্যমান। এই অবস্থায় দিন কয়েক আগে শক্তিশালী ও কাছের মিত্র চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের রাশিয়া সফর ঘিরে আশার দিশা খুঁজে পান পুতিন! পুতিনের আশা, এবার তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে! বিপদে বন্ধু পাশে এসে দাঁড়াবে সাহায্যের ডালি সাজিয়ে! সংকট, দুর্বল মুহূর্তে শক্তিশালী বন্ধুকে পাশের চেয়ারে পেলে ভেতরে আশার সঞ্চার ঘটা স্বাভাবিক বটে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে কতটা সহায়তা পাওয়া যায়, তাই বিচার্য।
দুর্দিনে মিত্র চীনের সরব উপস্থিতির প্রত্যাশা করতেই পারেন পুতিন—এতে দোষের কিছু নেই! হয়তো এর প্রতিদানও দিতে রাজি পুতিন। স্বল্প দামে জ্বালানি, পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর বয়কট করা বাজারে সহজ প্রবেশাধিকার, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক সাবমেরিন, সামরিক প্রযুক্তি—এসবের আশ্বাস তো দেবেনই, বন্ধু শি জিনপিংকে পুতিন সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন তা হলো ‘প্রতিশ্রুতি’। বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রশ্নে উদীয়মান চীন যে ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ লালন করে এগিয়ে চলেছে, তা বাস্তবে রূপ দিতে একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হবেন পুতিন। সম্প্রতি পুতিন-শি বৈঠকে দুই স্বৈরশাসকের মধ্যে এ ধরনের নানা বিষয়ে যে কথাবার্তা, আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি চালাচালি হয়নি, কে বলতে পারে?
ইউক্রেনে পুতিনের সামরিক আগ্রাসনের পর থেকেই শির কণ্ঠে ‘নিরপেক্ষতার বাণী’ শুনে আসছে বিশ্ব। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি সেই কথা বলে? বিশেষ করে, মস্কোয় পুতিনের সঙ্গে শির তিন দিনের বৈঠক কী বার্তা দেয়? একদিক থেকে বিচার করলে একে ‘ঐতিহাসিক রেকর্ড’ হিসেবে অবিহিত করা যায়! এর কারণ, গত বছর রাশিয়ার সঙ্গে চীনের তথা পুতিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রশ্নে ‘কোনো সীমা নেই’ বলে ঘোষণা করেছিলেন শি। পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই মিত্রের অংশীদারিত্ব কেবল বাড়ছেই—প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। বাস্তবতা হলো, পুতিনের সঙ্গে শির ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’ টাইপের বাজি ধরার পেছনে আসল কারণ হলো ‘ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্কে টানাপড়েন।
ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান বাস্তবতায় এটা এখন স্পষ্ট, মোটা দাগে দুইটি বিষয়কে কেন্দ্র করে চলমান সংঘাত ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমত, বিভিন্ন পক্ষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততায় ইউক্রেন যুদ্ধ একটি প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। কোনো শক্তি কিংবা কোনো নীতি আগামী দিনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে, বৈশ্বিক ভবিষ্যেক রূপ দেবে, তা নিয়ে রেষারেষি চলছে। প্রথম পক্ষে রয়েছে ১৯৪৫ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী নিয়ম ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার বার্তা বহন করে চলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। দ্বিতীয় দলে দেখা যাচ্ছে চীন ও তার স্বৈরাচারী অংশীদার তথা রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে গ্লোবাল সাউথের কিছু দেশ, যারা যুদ্ধ থেকে নিজেদের দূরে আপাতত সরিয়ে রেখেছে। দরকষাকষি চলছে আরো কিছু দেশ নিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশকেও দলে ভেড়ানোর প্রবণতা লক্ষণীয়!
দ্বিতীয় বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধে প্রত্যাশা মতো সুবিধা করে উঠতে না পারার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি বেশ খানিকটা বেসামাল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া এই যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক ক্ষয়ক্ষতিও বিপুল। এই অবস্থায়, কী খেলা খেলতে হবে তা অজানা নয় কোনো পক্ষেরই! শি ভালোমতোই বুঝতে পারছেন, ‘চীনই রাশিয়ার শেষ আশা, সর্বশেষ ভরসা’। এ কথাও শির ভালোই জানা, ইউক্রেনে যুদ্ধ চলবে নাকি সংঘাত বন্ধ হয়ে শান্তির পতাকা উড়বে, তা অনেকখানি নির্ভর করছে রাশিয়ার পক্ষে চীনের যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে। এই চিন্তা থেকে পুতিনের মতো শিও বাজি ধরছেন, কে কতক্ষণ যুদ্ধের ময়দান কামড়ে পড়ে থাকতে পারে? যুদ্ধে রাশিয়াই শুধু ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে না, পশ্চিমা পক্ষেরও অনেক কিছু যাবে-আসবে। যুদ্ধ জিইয়ে রাখার মাশুল বহুগুণে ভোগ করতে হবে বিশেষ করে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন নির্বাচনের সময়!
সহজ হিসাব হলো, ইউক্রেন যুদ্ধে বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে শির চীন। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, চীনের কোনো একটি পক্ষকে সমর্থন করা-না করার ওপরই এই যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করছে। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায়, প্রেসিডেন্ট শি অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত স্থির করেছেন যে, আপাতত ‘নিরপেক্ষ’ থাকার ভান করাই হবে বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত! তবে এ কথাও শির বেশ ভালোভাবে জানা, পুতিনের জয়-পরাজয়ে যে বৈশ্বিক প্রভাব পড়বে, তার উত্তাপ সবচেয়ে বেশি লাগবে চীন ও শির গায়ে। তাইওয়ানকে শুষে নেওয়ার চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তো অধরা থেকে যাবেই, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক তীব্র চাপের মুখেও পড়বেন শি। আরো স্পষ্ট করে বললে, বিশ্বের অত্যন্ত প্রতাপশালী স্বৈরশাসকের পতন চরম দুর্দিন, দুঃসংবাদ বয়ে আনবে অন্য একনায়কদের জন্যও।
বস্তুত, শির বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন সীমাহীন! টিকে থাকার জন্য যখন পুতিন নিজের মিত্রদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন, তখন অন্যখানে মনোযোগ শির! বিশ্বব্যাপী প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদি খেলার অংশ হিসেবে শি নানা কায়দা আঁটছেন! শি এমন সব কাজ করছেন, এমন সব কথাবার্তা বলছেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে কয়েক ধাপ নিচে নামিয়ে দেয়! যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার মাত্র কয়েক দিন পরই পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে শির ছুটে যাওয়ার ঘটনাকে কি ছোট বিষয় হিসেবে দেখার অবকাশ আছে? এর মধ্য দিয়ে কি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে শির উচ্চাকাঙ্ক্ষার চিত্র ফুটে ওঠে না? মস্কো সফরে শিকে বলতে শোনা গেছে, ‘বিশ্বে আজ এমন সব পরিবর্তন ঘটেছে, যা বিগত ১০০ বছরেও ঘটেনি।’ সত্যিই কি তাই? এমনকি তিনি এ-ও বলেছেন, ‘আমরা (রাশিয়া-চীন) যদি একসঙ্গে থাকি, তবে এই পরিবর্তন ধরে রাখা যাবে’। শির এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে রাখা দরকার, যারা ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘আঞ্চলিক সংগ্রাম’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন, তাদের ধারণা কি বাস্তবসম্মত, যুক্তিসংগত? তিন দিন ধরে শি-পুতিন মোলাকাতের পর চীন যে বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তা পড়লেই এর উত্তর মিলবে।
চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘রাশিয়া-চীন সম্পর্ক এখন আর শুধু দ্বিপাক্ষিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নেই, বরং বৈশ্বিক ল্যান্ডস্কেপ ও মানবতার জন্য এটা অনেক বেশি গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে।’ ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে পুতিনের প্রতিক্রিয়াও একই সাক্ষ্য দেয়—‘আমরা আরো ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গঠনে সংহতি নিয়ে কাজ করতে চাই। জাতিসংঘ ও এর নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক আইন ও এর উদ্দেশ্য, নীতির ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যেতে চাই, যেমনটা বলা আছে জাতিসংঘ সনদে।
সত্যি বলতে, এটা তো নিখাদ ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়! শি কিংবা পুতিন—যেই হোন না কেন, জাতিসংঘ সনদের প্রসঙ্গ টানলে তো সবার আগে তাকেই সনদের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিন কি তার ধার ধারছেন? ২৪ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন-সার্বভৌম ইউক্রেনে আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে ‘সব দেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা’ নিয়ে জাতিসংঘ সনদে যা বলা হয়েছে, তিনি কি তা কি লঙ্ঘন করেননি?
পুতিন-শি মূলত একটি পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা অঙ্কনের চেষ্টা করছেন। ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একধরনের প্রচেষ্টাও দেখা গেছে সম্প্রতি। চলতি মাসের শুরুর দিকে ইরান ও সৌদিকে এক টেবিলে বসিয়ে বিশ্বকে চমকে দেন শি! যদি এমন হয়, মধ্যপ্রাচ্যে শির মিশন সফল, তবে এটা ধরে নেওয়া অমূলক হবে না, আফ্রিকা থেকে লাতিন আমেরিকা এমনকি দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত নিজের বলয়ে নেওয়ার মিশনে নেমেছে এই পক্ষ!
যাহোক, গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে বিভাজন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় কী ধরনের ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’ গড়ে উঠবে নাকি এসব শুধুই কথার কথা, তাই দেখার বিষয়। এই সপ্তাহে রাশিয়ান জাররা মস্কোতে জড়ো হতে চলেছেন বলে শোনা গেছে। তারা হয়তো ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের এই বার্তা দিতে চায়, কৌশলগত প্রতিযোগিতা এখন আর কেবল একটি তত্ত্ব নয়, বরং এটাই আজকের বিশের বাস্তবতা।