ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক তরুণীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘নিষ্ক্রিয়তা’র কঠোর সমালোচনা করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। তারা বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর একটি গৌরবের জায়গা। এই চত্বরকে অরক্ষিত ও অসম্মানের জায়গা করে রাখা হলে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হবে। একই সঙ্গে তরুণীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে মহিলা পরিষদ।আজ রোববার বিকেলে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক প্রতিবাদ সমাবেশে মহিলা পরিষদের নেতারা এসব কথা বলেন। গত বুধবার মধ্যরাতে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে রিকশায় করে পুরান ঢাকার বাসায় যাওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের সামনে একজন তরুণী এক হেলমেটধারী বখাটের যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। একটি এফএম রেডিও স্টেশনে কর্মরত ওই তরুণী এ ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন৷
ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানির ঘটনার প্রতিবাদে মহিলা পরিষদের সমাবেশে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারীদের বহুমাত্রিক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমমর্যাদার কথা বলা হয়েছে। আজ নারীরা সব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অবদান রেখে চলেছেন৷ তাঁদের ভূমিকা আজ দেশে-বিদেশে সর্বত্র স্বীকৃত। যাঁরা নারীকে যৌন হয়রানি করার স্পর্ধা দেখান, তাঁদের জন্য রাষ্ট্রকেই জবাবদিহি করতে হবে। সব ক্ষেত্রে সব জায়গায় নারীর মানবাধিকার ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রশাসন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও শাহবাগ থানাকে সম্মিলিতভাবে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যৌন হয়রানির কোনো ঘটনা ঘটলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
যে মৌলবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি নারীর চলাচল ও পোশাকের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও আক্রমণ করতে চায়, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসহ সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান মালেকা বানু।
তিনি আরও বলেন, ‘যে কাপুরুষ ভাইটি রাতের বেলায় একজন নারী নির্ভয়ে গন্তব্যে যাওয়ার সময় তার পোশাক ও শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, কী ধরনের শিক্ষার ফলে তার এ ধরনের একটি কাজ করার মানসিকতা তৈরি হলো? ফলে এ ধরনের শিক্ষার পরিবর্তে নতুন ধরনের শিক্ষা লাগবে৷ নারীদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পুরুষদের বলব, সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হোন। তা না হলে আপনার পরিবারেও একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে৷ আর এ ধরনের অপতৎপরতা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বিপন্ন করবে৷ তাই যেখানেই নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন নির্যাতন হবে, সেখানেই এর বিরুদ্ধে সবাইকে একসঙ্গে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মহিলা পরিষদের আইনজীবী রাম লাল রাহা৷ তিনি বলেন, ‘একটা স্বাধীন দেশে কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তা ভাবতে গেলে শিহরিত হতে হয়৷ আমাদের দাবি সুস্পষ্ট, যে দুষ্কৃতকারী ওই নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তাকে দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়৷ এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সরকারকে আইন প্রণয়ন করতে হবে৷’
সমাবেশে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী রিদিয়া রাকা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানির ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না৷ এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে, তাদের বলতে চাই, পোশাক ও শরীর বিষয়ে প্রতিটি নারী একজন স্বাধীন মানুষ৷ আমাদের সবাইকে সম্মান দিতে হবে, কোথাও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলে প্রতিহত করতে হবে।’
ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী নির্জনা ভূঁইয়া বলেন, ‘জামা ছোট না বড়—এসব নিয়ে কেন নারীকে জবাবদিহি করতে হয়? এসব কেন সমাজ নির্ধারণ করে দেবে? স্বাধীন মানুষ হিসেবে কী পোশাক পরব, সেটি আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছার বিষয়।’
মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ দফা প্রস্তাব পড়ে শোনান সংগঠনের অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক জনা গোস্বামী৷ সমাবেশে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা হাত তুলে এসব প্রস্তাবের সঙ্গে একাত্মতা জানান৷ এই ১১ দফার মধ্যে আছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্যাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা; উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে পৃথক আইন প্রণয়ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে নিয়মিত নজরদারি করা৷
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম৷ তিনি বলেন, ‘বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একজন নারী এবং একজন মানুষ অসম্মানের শিকার হয়েছেন৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা প্রক্টরের কাছ থেকে কোনো কথা শুনলাম না৷ তাঁরা বললেন না যে এই ঘটনা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত৷ চার দিন লেগেছে সিসি ক্যামেরার ফুটে
ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি অসম্মান বা সহিংসতা মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর সবার গৌরবের জায়গা৷ এই চত্বরকে অরক্ষিত ও অসম্মানের জায়গা করে রাখা হলে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হবে৷ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তাদের এগিয়ে আসতে হবে৷
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সর্বদলীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম।
মহিলা পরিষদের নেতা দীপ্তি সিকদারের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম ও মাসুদা রেহানা বেগম, লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা, আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন শান্তি প্রমুখ বক্তব্য দেন৷
এদিকে সমালোচনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী প্রচলিত আইনে মামলা করেছেন৷ এখন এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার পুলিশের৷ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুলিশকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে এবং করে যাবে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বলেন, ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।