হঠাৎ করেই শুরু এবং আকস্মিকভাবেই শেষ! কয়েক মুহূর্ত আগেও যা ছিল কল্পনার বাইরে, ঘণ্টা চব্বিশের ব্যবধানে তা-ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হয় পুতিনের রাশিয়া! রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা ও সেনা সরবরাহকারী ওয়াগনার গ্রুপ আক্রমণ শানিয়ে ঢুকে পড়ে খোদ পুতিনের সীমানার মধ্যে! রুশ জেনারেল ও সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের প্রকাশ্য বিদ্রোহের হাত ধরে ‘মস্কোয় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি’র সাক্ষী হয় গোটা বিশ্ব!
গত কয়েক দিন ধরে এমন সব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। নিজেরই ভাড়া করা সেনা-সামন্তের তোপের মুখে পড়ে বেহাল অবস্থায় নিপতিত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার নিজের লোক তোপ দাগছে স্বয়ং তার দিকেই—কী করুণ চিত্র! বেলারুশের নেতা লুকাশেংকোর মধ্যস্থতায় ক্রেমলিন ও ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যে আপাতত আপোসরফা হলেও রাশিয়া ও পুতিনের অবস্থাকে বেশ ঘোলাটেই বলতে হবে। সংকট কেটেছে বটে, তবে অত্যন্ত ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট পুতিনকে যেন হঠাৎ করেই অতিশয় দুর্বল ও নাজুক দেখাচ্ছে! কিছু বিশ্লেষক ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, ‘পুতিনের শাসনব্যবস্থা কতটা নড়বড়ে অবস্থায় আছে, ওয়াগনার গ্রুপের এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তা পরিষ্কারভাবে দেখা গেল!’ অর্থাত্, সহজ ভাষায় বললে, ক্ষমতাধর রাশিয়া ও অত্যন্ত প্রতাপশালী পুতিন সম্পর্কে যে ‘অদৃশ্য পর্দা’ ছিল মানুষের চোখে, তা সরে গেছে মাত্র ঘণ্টা কয়েকের বিদ্রোহের তোড়ে।
যারা এখনো রাশিয়ার ঘটনাকে ‘ছোট ও স্বাভাবিক’ বলে মনে করছেন, তাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত গত শনিবার সকালে প্রেসিডেন্ট পুতিনের জাতির উদ্দেশে দেওয়া টেলিভিশন ভাষণের ওপর। এদিন ভাষণ দানকালে পুতিনের মুখের অভিব্যক্তি ছিল বেশ হতাশ, কিন্তু কঠোর এবং গুরুগম্ভীর, যা দৃষ্টি এড়াতে পারেনি বিশ্লেষকদের। সে সময় তাকে ওয়াগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিতে দেখা গেলেও দিন শেষে ঘটতে দেখা যায়নি তেমনটা। বেলারুশে দিব্যি সময় কাটাচ্ছেন ওয়াগনার প্রধান! অন্যদিকে, আকস্মিক সমঝোতার ঘোষণার পর বাইরে দেখা যাচ্ছে না বরং পুতিনকেই! এ নিয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত খোলাসা করে বলা হচ্ছে না কিছুই! এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ‘রাশিয়া ও পুতিনের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না’ বলে ধরে নেওয়াটাই কি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়? আমরা দেখেছি, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন রোববার গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ওয়াগনার গ্রুপের এই বিদ্রোহ প্রেসিডেন্ট পুতিনের শাসনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ। এবং এতে করে গভীর প্রশ্ন ওঠার অবকাশ রয়েছে।’ অর্থাৎ, অতি স্বল্প সময়ের বিদ্রোহ মহাশক্তিধর সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে, বলা যায়।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, প্রিগোজিন ও ক্রেমলিনের মধ্যকার চুক্তির বিশদ বিবরণ ‘অস্পষ্ট’ রাখা হয়েছে, যাকে রহস্যজনক না বলে উপায় নেই। তবে এর পরও নিজের নাজুক অবস্থাকে কি আড়াল করতে পারছেন পুতিন? বরং এতে করে রাশিয়া কিংবা পুতিনের যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের আবহমান চিত্রই ক্রমাগতভাবে প্রকাশ্য হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। ‘ওয়াগনার গ্রুপ ইস্যু’ নিয়ে উৎভূত সমস্যার সমাধান টানা গেছে; তবে মনে রাখতে হবে, ‘এটা আপাতত, তথা আপাতত সমাধান।’
তাৎপর্যপূর্ণ কথা হলো, এ ঘটনার পর ভ্লাদিমির পুতিন বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। প্রকাশ্যে অপমানিত হয়েছেন তিনি। পুতিন ও রাশিয়ার শক্তিমত্তা নিয়েও নানা কথাবার্তা চাউর হচ্ছে ক্রমাগতভাবে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শাসনামলের সবচেয়ে ‘দুর্বল’ সময়ের মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছেন পুতিন, যা তার জন্য ‘বড় দুর্ভোগের কারণ’ হয়ে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। এ প্রসঙ্গে আবারও বলতে হয়, যদিও এই বিদ্রোহ ছিল লক্ষণীয়ভাবে খুবই স্বল্পকালের, তবে তা ‘দীর্ঘমেয়াদি ও বড় অভিঘাতের বীজ’ পুঁতে দিয়ে গেছে! বিশেষ করে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে এই বিদ্রোহের আগুন রাশিয়ার জন্য ‘উত্তাপ’ বয়ে আনবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ওপরের দাবির পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো যাক। পরিষ্কার হিসাব হলো, ওয়াগনার বিদ্রোহের কারণে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে রুশ সেনাশিবিরের ওপর। ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রাশিয়ার শক্তিও ক্রমশ ভঙ্গুর হতে থাকবে। অর্থাত্, রাশিয়া কিংবা পুতিন ক্রমাগতভাবে ‘দুর্বল’ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকবেন আগামী দিনগুলোতে।
আগেই বলা হয়েছে, সবচেয়ে বড় অভিঘাত পরিলক্ষিত হবে ইউক্রেনের মাটিতে যুদ্ধরত রুশ সেনাদের ওপর। স্মরণে রাখতে হবে, বিদ্রোহ করে যুদ্ধের ময়দান থেকে বের হয়ে এসেছে ২০ হাজারেরও বেশি ওয়াগনার সেনা। এর ফলে যুদ্ধরত সেনাবহর থেকে পাঁচ ভাগের এক ভাগ সেনা হারিয়েছে রাশিয়া। রুশ সেনাবাহিনীর জন্য খারাপ সংবাদ হলো, চলে যাওয়া সেনারাই ছিল ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর আসল অস্ত্র! সুতরাং, সম্মুখ সারির সেনাবহর হারিয়ে রাশিয়ান বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়বে স্বভাবতই, যা পুতিনের জন্যও বড় দুঃসংবাদ নিঃসন্দেহে।
উল্লেখ করা দরকার, ইউক্রেন যুদ্ধে ওয়াগনার সেনাদের পারফরম্যান্স বেশ প্রশংসনীয়। বিগত এক বছরে তাদের সাফল্যকে তুলনামূলক আকাশচুম্বীই বলতে হবে। যা হোক, বিদ্রোহ-পরবর্তী সমঝোতা চুক্তির পর অনেক সেনাই হয়তোবা থেকে যাবেন রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে। বিপত্তি বাঁধবে এখানেই! নন-ওয়াগনার কমরেড ও কমান্ডাররা তাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করবেন না কিংবা চরম সন্দেহের চোখে দেখবেন না—এই গ্যারান্টি কে দিতে পারবে? তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়াগনার গ্রুপের ‘থেকে যাওয়া সেনা’দের প্রভাবও অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়বে। সহজ করে বললে, সেনাসক্ষমতা কমে গিয়ে যুদ্ধে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়বে রুশ বাহিনী। আগামী দিনে রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইউক্রেন যুদ্ধে ভালো বা খারাপ যা-ই করুক না কেন, যুদ্ধে ওয়াগনার সেনাদের ওপর রাশিয়ার ভরসা করার দিন শেষ হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়াটাই বিচক্ষণ চিন্তা।
ওয়াগনার বিদ্রোহের আরেকটি বড় ধাক্কা হলো, এর ফলে রাশিয়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা পড়েছে বড় প্রশ্নের মুখে। পুতিন প্রশাসনের প্রতিরক্ষাহীনতা নিয়ে উঠছে নানা কথা। ভুলে গেলে চলবে না, ইউক্রেনের ছোট শহর বাখমুতের দখল নিতে ওয়াগনার সেনাদের লম্বা সময় লাগলেও (প্রায় এক বছর) মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই এবং কোনো ধরনের লড়াই ও বাধাবিপত্তি ছাড়াই বাখমুতের প্রায় বিশ গুণ বড় রাশিয়ার শহর রোস্তভ-অন-ডন বেদখল হয়ে যায় ওয়াগনার গ্রুপের হাতে! পুতিনের শাসনব্যবস্থার এহেন নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কথা চালাচালি চলছে রাশিয়ার ভেতরে-বাইরে।
বাস্তবতা হলো, মস্কোকে আপাতত বিদ্রোহের ব্যাপারে ভাবতে হচ্ছে না বটে, কিন্তু বিষয়টিকে একেবারে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাও সম্ভব হবে না রাশিয়া ও পুতিনের পক্ষে। এ কথা পুতিনও জানেন বেশ ভালোমতোই! পর্যবেক্ষক বিশ্বের চোখে রাশিয়া তথা পুতিনের দুর্বলতা ধরা পড়ে গেছে—সম্ভবত এটাই পুতিনের জন্য ‘বড় ক্ষয়ক্ষতি’।
পুতিনের জন্য আগামী দিনে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসবে আরেকটি বিষয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে তাকে। প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মজবুত করতে গেলে তার নতুন করে সেনার প্রয়োজন পড়বে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেনা সরঞ্জাম কোথায় পাবেন পুতিন? এমতাবস্থায় দেশের গুরুতর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সমস্যা মোকাবিলায় ইউক্রেনে যুদ্ধরত সেনাদের থেকে আক্রমণের শক্তি কমানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। অর্থাত্, সুস্পষ্টভাবে ‘বিশ্রী’ অবস্থায় পড়তে চলেছেন পুতিন! একদিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে ইউক্রেন যুদ্ধে বাজে ফল করার আশঙ্কা—সব মিলিয়ে বহুমুখী সমস্যার সামনে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন পুতিন!
আরেকটি বিষয়, এই বিদ্রোহ পুতিনের অব্যাহত শাসনক্ষমতার কিছু মৌলিক দিক নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে! সংকট শুরুর দিককার সময়গুলোতে অনুপস্থিত ছিলেন পুতিন। শুধু পরদিন সকালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত ভিডিও ভাষণে দেখা গেছে তাকে। এরপর থেকে তিনি যেন উধাও! এত বড় ঘটনার পরও তাকে পর্দার আড়ালে অনেকটা চুপচাপ থাকতে দেখা যাচ্ছে! এসব বিষয়কে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে বইকি।
পরিশেষে বলতেই হয়, জার দ্বিতীয় নিকোলাসের মতো অসহায় অবস্থায় উপনীত হয়েছেন পুতিন। সামরিক ব্যর্থতা ও নিকোলাসের দুর্বল নেতৃত্বেও হাত ধরে যেভাবে পতন ঘটেছিল রাশিয়ান সাম্রাজ্যের, ঠিক একই রকম অবস্থার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে পুতিনের রাশিয়া! রাশিয়ান স্বৈরশাসক আগামী দিনে অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি ওয়াগনার বিদ্রোহের চেয়েও বড় ধরনের আন্দোলন-বিক্ষোভ-বিদ্রোহের মুখোমুখি হতে পারেন—এমন আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি এসবের ঘাত-প্রতিঘাতে ইউক্রেনের মাটিতেও পুতিন পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণে বাধ্য হন কি না, তা-ও দেখার বিষয়!