অর্থনীতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হচ্ছে ‘টাকা যত বাজারে পরিচালিত হবে ততই অর্থনীতি গতিশীল ও শক্তিশালী হবে।’ মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাধীন ক্ষুধা ও দরিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যবস্থা চালু করেন। একই সঙ্গে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিওবি তহবিল থেকে ৪৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে জামানত ও সুদবিহীন ঋণ প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ক্ষুদ্র অর্থায়ন বর্তমানে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প। বর্তমানে ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সরকারের নেওয়া উন্নয়ন কার্যক্রমগুলোতে ভূমিকা রাখছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে সব স্তরে কাজ করছে নিরলস। দেশের যেসব জনগোষ্ঠী সঞ্চয় করত না, ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রম চালু থাকার কারণে এ শিল্পে তাদেরও প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয় রয়েছে। তাই ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য তৃণমূল মানুষের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন।
শুধু প্রশিক্ষণ দিলেই হয় না, অংশীজনদের কিছু করে চলার পাথেয় দিতে হয়। দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষকে তার পাথেয় দিতে ক্ষুদ্র অর্থায়নের ভূমিকা অসামান্য। করোনা মহামারি প্রাদুর্ভাবের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপর ইউক্রেন -রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে তার অভিঘাত পুরো বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতিকে চড়া করে, বাংলাদেশেও ছড়ায় যার আঘাত। নতুন করে আরো ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র অর্থায়ন সংস্থাগুলো ধীরে হলেও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং অত্র জনগোষ্ঠীর অবস্থা পরিবর্তন করতে সহায়তা করছে। গ্রাহকদের বাড়তি চাহিদা মেটাতে ক্ষুদ্র অর্থায়ন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) গত ১৬ মাসে (এপ্রিল, ২০২৩) ২৯৩টি নতুন প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মতো লক্ষণীয় অর্জন। তথ্য -উপাত্ত বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও ঋণ বিতরণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রয়েছে, এ সময়ে বিতরণ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প এই ক্ষুদ্র অর্থায়ন। জিডিপিতে এর অবদান ১৪ শতাংশের থেকেও বেশি। বাংলাদেশে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত এনজিওর সংখ্যা এখন ২ হাজার ৫৫৯। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শুরু হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ কার্যক্রম। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে, ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট ইকোনমি গড়তে বাংলাদেশ সরকার বদ্ধপরিকর। তাই স্মার্ট ইকোনমি গঠনে বাংলাদেশ সরকারের উচিত ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলোকে অনুধাবন করে সহজ নীতি প্রণয়ন করা। কারণ ক্ষুদ্র অর্থায়ন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষুম কার্যক্রম পরিচালনাকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে।
ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঋণগ্রহীতার প্রশিক্ষণ, আত্মোন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নসহ আরো কার্যক্রম। সেসব কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা, কৃষি, দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসুরক্ষা ইত্যাদি। করোনা মহামারিকালীন একের পর এক বিধিনিষেধের কারণে ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছিল। ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (সিডিএফ) করোনা মহামারিকালীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আপত্কালীন সময়ে সংগঠনটি অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক এবং থিংক ট্যাংকারদের সঙ্গে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখতে কাজ করেছিল। সিডিএফের সহযোগিতায় সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা পেয়েছিল ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, যা একটি মাইলফলক। তাই অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রমের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে, যে কোনো পরিস্থিতিতে চালু রাখতে হবে এর কার্যক্রম।
সিডিএফ করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রমের বিভিন্ন উদীয়মান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সভা, সেমিনার, আলোচনা এবং কর্মশালার আয়োজন অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অ্যাডভোকেসি এবং লবিং করছে সংগঠনটি। এর পাশাপাশি সিডিএফ বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র অর্থায়নের ভবিষ্যতের ওপর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে আর্থিক পরিষেবার বৈচিত্র্যকরণ, ডিজিটাল অর্থনৈতিক কার্যক্রম, অর্থনৈতিক শিক্ষার প্রসার, সরকার ও উন্নযন অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই পরিবেশের উন্নয়ন ইত্যাদি। এছাড়া সিডিএফ বাংলাদেশে সবুজ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অগ্রগতিতে কাজ করে যাচ্ছে নিরলস। তবে সিডিএফের চেয়ারম্যান হিসেবে একটি কথা জোর দিয়ে বলব, ক্ষুদ্র অর্থায়নকে দারিদ্র্য -মুক্তির একমাত্র উপায? হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। বরং টেকসই এবং উল্লেখযোগ্যভাবে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য, অর্থনৈতিক বিকাশের সব প্রচেষ্টাতেই ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট ইকোনমি গড়তে বাংলাদেশ সরকার বদ্ধপরিকর। তাই স্মার্ট ইকোনমি গঠনে বাংলাদেশ সরকারের উচিত, ক্ষুদ্র অর্থায়ন কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলোকে অনুধাবন করে সহজ নীতি প্রণয়ন করা।