পড়ন্ত বিকালে নিভান্ত রোদে বের হতে হয়েছিল দোকানে টুকি- টাকি কিছু কিনতে। আমার বাড়ীর কাছেই মোড় ঘুডতেই বেশ বড় একটি গির্জা। খিৃস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থান। দেখেছি প্রতি রবিবার এখানে সমবেত হয় প্রচুর লোক। তারা প্রার্থনা করে, আলোচনা করে তাদের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে। আগামী সপ্তাহে তাদের বড় দিন। সেই কারণে ঘর-বাড়ি লন দোকান-পাট সব কিছুতেই রং-বেরংয়ের লাইট দিয়ে সজ্জিত করা হয় আর সান্তা ক্লজ, হরিন এবং খিৃস্টমাস ট্রিসহ নানান ধরনের মোজা এবং উপহারের বক্স বাড়ীর আঙিনায় কিম্বা বাড়ী ঘিরে লাইট লাগিয়ে অঘোষিত ভাবে কে কাকে টেক্কা মারবে তা এক রকম প্রতিযোগিতাও হয়।
আমার বন্ধু রবার্টকে দেখলাম সে এক ভদ্র লোকের সাথে কথা বলছে। কাছে যেতেই শুনলাম তিনি জানতে চাইছেন খিৃস্টমাসকে কেন আপনারা বড়দিন বলেন? এ প্রশ্নের পর রবার্ট আমাদের দুইজনকে সঙ্গী করে চার্চের ভিতর প্রবেশ করলো, সেখানে প্রবেশ করতেই নজরে এলো দ্বারের সন্নিকটে একটা গোয়াল ঘর, সেই ঘরে এক নারীর কোলে একটি শিশু দেখে মতিন সাহেব জানতে চাইলেন যদিও আমি জানি এই শিশুটিই আপনাদের ত্রানকর্তা যিশু এবং আমি এটাও জানি তিনি আমাদেরও নবী। কিন্তু কথা হলো সেই আমলে কেন যিশুকে দিনহীন ভাবে জন্ম নিতে হলো?
আমার বন্ধু রবার্ট মতিনের কৌতুহল নিবৃত্ত করতে তাদের ধর্মের সংক্ষেপে আদ্যপান্ত বলে গেলো। তার কথার নির্যাস হলো এই যে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে ইসরাইলের নাজারাত থেকে বেথেলহামে দলে দলে লোকজন জড়ো হচ্ছিলো কারণ রাজা তার দেশবাসীকে লোক গননা (সেন্সাস) করার জন্য তাদের আসতে বলেছিলো তাই জোসেফের বাগদত্তা মেরীও এসেছিল গাধার পিঠে চেপে জোসেফের সাথে, মা মেরী ছিল গর্ভবতী। তারা যখন বেথেলহামে পৌছালো তখন রাত্রি যাপনের জন্য কোন মাথা গুজার ঠাঁই পেলো না, শেষে এক গোয়াল ঘরে আশ্রয় নিলো। সেখানেই মেরী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিল আর সেই সদ্যজাত শিশুটিই হলো যিশু (আঃ) তারিখটি ছিল সেদিন ২৫ ডিসেম্বর যার ফলে ঐ তারিখই আমাদের বড় দিন। সে সময় সে রাজ্যে চলছিল ভয়াবহ অরাজাকতা, অধিবাসীরা ঘুষ, খুন, কুৎসা রটনা থেকে শুরু করে হেন কিছু নাই যাতে তারা লিপ্ত হতো না। তারপরও ইহুদী জাতি আশা করতো তারা আবার ক্ষমতাশালী হবে। এই ছিল তাদের স্বপ্ন। রোম রাস্ট্রসহ অনেক জায়গায় তারা ছরিয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতে লাগলো, এহেন অবস্তায় তারা ভাবতো তাদের হানাহানি থেকে রক্ষা করতে আসবে একজন মেজায়া বা উদ্ধারকারী, আবার তাদের জীবনে শুভ দিন আসবে, এই বিশ্বাস তারা হারালো না। এদের না ছিল ঘরবাডী, না ছিল আশ্রয়, এদের উপর চলেছে অত্যাচার এমন কি নির্বিচারে হত্যা। তা সত্ত্বেও এই ইহুদি জাতি দু হাজার বছর টিকে ছিল, এবং বজায় রেখেছিল নিজেদের বৈশিস্ট্য, সেটা ইতিহাস, সেটা এক বিশ্বয়কর ব্যাপার। অতি সাধারণ পরিবেশে এবং নিঃস্ব অবস্হায় যীশু যখন ভূমিষ্ট হলো তখন সেটা ছিল অনেক তাৎপর্যপূর্ন। ইহুদিরা ভেবেছিল এই শিশুটিই তাদের অভাব থেকে অনাচার থেকে রক্ষা করবে, কিন্তু এই শিশু যখন বড় হলো তখন এই ইহুদী জাতির হাব-ভাব নীতি-রীতি কিছুই তার ভাল লাগেনি এদিকে যিশুর কথা বার্তাও ইহুদিদের ভাল লাগলো না তাই তারা যিশুর বিরোধিতা করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তাকে রোমান গভর্নর পন্টিয়স পিলেটের হাতে হস্তান্তর করলো। তখন রোমের সম্রাট ছিল টিবেরাস। তিনিও এ ব্যাপারে মাথা ঘামাননি। কিন্ত ইহুদিরা যখন গভর্নরকে বোঝাতে সক্ষম হলো তখন তার বিচার কার্য শুরু হলো, এবং সেই বিচারে তার মৃত্যুদন্ডের রায় ঘোষিত হলো এবং যিশুর ক্রশে বিদ্ধ করে হত্যা করা হলো।
নিঃস্ব, রিক্তি, রুগ্ন, ও হতদরিদ্র মানুষের ত্রাতা হিসাবেই তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন, লক্ষ্যনীয় যিশুর জন্ম হয়েছিল ইহুদী পরিবারে তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনিও ছিলেন ইহুদি। এই ইহুদীরা এক অদ্ভুত নাছোড়বান্দা জাতের লোক। যিশু ইহুদি ধর্মের জায়গায় খৃস্টান ধর্মের প্রবর্তন করেন। উল্লেখ্য যিশুর জন্মদিনেই অর্থ্যাত ২৫ ডিসেম্বরকেই খ্রিস্টনরা আনন্দ ও মুক্তির দিন হিসাবে পালন করতে শুরু করে। একটা ব্যাপার লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, আমাদের বড় দিন পালনের অনেক পরে কার্ড দেওয়া নেওয়া এবং পরস্পর পরস্পরের মধ্য কার্ড আদান-প্রদান করে থাকে আর এটার প্রচলন হয়েছিল লন্ডনে ১৮৪৩ সালে স্যার হেনরি কোল এর হাত ধরে। আর তখন কার্ড ছাপা হয়েছিল মোট ২০৫০ টি। সেই কার্ডে ছবি ছিল একটি পরিবারের সাথে একটি শিশু। পরবর্তিতে ১৮৭৫ সালে আমেরিকায় ছাপা হয়েছিল শুভেচ্ছা কার্ড হিসাবে। সেখানে (কার্ড) ছবি হিসাবে ছাপানো হয়েছিল মা মেরি ও যিশুর।
খ্রিস্টান ধর্ম, জন প্রবাদ, লোকগাথা, ইতিহাস মিলিয়ে সান্তাক্লজ এর জন্ম হলো। জার্মান লোকগাথা অনুযায়ী সান্তাক্লজের সঙে মিল খুঁজে পাওয়া যায় দেবতা ওডিনের, তিনি আকাশ পথে উড়ে যেতেন আট পা-ওয়ালা ঘোড়ার সওয়ারী হয়ে। আর ছোট ছোট শিশুরা ঘোড়ার জন্য চিমনীর কাছে রেখে দিতো গাজর, চিনি ও ঘাস। দেবতা ওডিন তার ঘোড়াকে সেগুলি খাওয়ানোর পর শিশুদের জন্য রেখে যেতেন চকোলেট, মিস্টি ও খেলনা। সেই থেকে শিশুরা মনে করতো বড়দিনে সান্তাক্লজ আসবে এবং তাদের জন্য খেলনা উপহার রেখে যাবে।
এখানে ট্রি-র একটা ভূমিকা রয়েছে, সেটা হলো এক এক দেশে গাছ সাজানোর রেওয়াজ ছিল যেমন, মিশরীয়া শীত কালের উৎসবে তাল জাতীয় গাছ সাজাতো, রোমানরাও গাছ সাজাতো তাদের উৎসবে তবে তাদের কোন নির্দিষ্ট গাছ ছিল না। তবে ১৫ শতকে লন্ডনের প্রতিটি বাড়ি ও গির্জায় আইভিলতা গাছ দিয়ে সাজাতো, তাদের বিশ্বাস ছিল আইভিলতার পাতা হচ্ছে পৃথিবীতে যিশুর আগমনের বার্তা। এই আইভিলতা গাছ অনেকটা দেবদারু গাছের মত। তবে এই কথা ঠিক বর্তমানে এই গাছ সাজানো শুরু হয় জার্মান থেকে।
ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী জার্মান রাজপুত্র আর্লবাট প্রথম ক্রিসমাস ট্রি সাজান। ১৮৪১ সালের ক্রিসমাসের উইন্ডসর প্রাসাদে অনেকটা পারিবারিক ভাবেই ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়। আর এভাবেই জার্মান যুবরাজ (রানীর স্বামী) আর্লবাট নিজের দেশের রীতি চালু করেন ইংল্যান্ডে। তারপর থেকেই বডদিনে এই ক্রিস্টমাস-ট্রি’র প্রচলন শুরু হয়। রবার্ট একটু থামতেই ভদ্রলোক আরও কিছু জানতে চাইছিলো কিন্ত রবার্ট সেদিন ব্যাস্ত থাকায় পরে আর একদিন আসতে বলে সে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। আমি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে আমার কাজে বেড়িয়ে গেলাম।