খুচরা ব্যবসাকে বলা হয় একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ। খুচরা ব্যবসায় বিক্রি বাড়লে মনে করা হয় মানুষের কাছে অর্থ আছে। আর বিক্রি পড়ে গেলে এর উলটোটা ধরা হয়। বাংলাদেশে খুচরা ব্যবসায়ীদের দোকানদার হিসেবে ধরা হয়। তাদের দিন খুব খারাপ যাচ্ছে। বিক্রি কমে গেছে। অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন পেশা। বিভিন্ন শপিং মলের দোকানে শাটার ঝুলছে। দোকানদারি করে ভাড়ার টাকাও তুলতে পারছেন না অনেকে। রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে দোকানদারদের করুণ চিত্র দেখা গেছে।
প্রথমে করোনার ধাক্কা, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তাতে কমেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। যার প্রভাব পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি সব ব্যবসার ওপর। খাদ্যপণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া খুবই কমই কেনাকাটা করছেন অনেকে।
মিরপুর শপিং সেন্টারের একটি পাঞ্জাবির শো রুমের মালিক রফিকুল হাসান বলেন, দোকানে একদম বিক্রি নেই। সামনে রমজানের ঈদে যদি বিক্রি না হয়, খরচ উঠাতে না পারি, তাহলে দোকান ছেড়ে দেব। কোনো দিন এক-দুইটা বিক্রি হয়। আবার কোনো কোনো দিন খালি হাতে ফিরতে হয়। এখন বিকাল ৩টা বাজে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিক্রি হয়নি। তিনি বলেন, আগে যে পাঞ্জাবি ৭০০ টাকায় কিনেছি সেটি এখন ৯০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এই দাম তো আমি কাস্টমারের কাছে চাপিয়ে দিতে পারি না।
তিনি আরো বলেন, ভাড়া বেড়েছে, বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে। কিন্তু আমার বিক্রি তো বাড়েনি। খরচ বাঁচাতে সেলসম্যান ছাড়াই এখন নিজেই দোকান চালাচ্ছি। অন্যদিকে উৎপাদনের ক্ষেত্রেও খরচ বেড়েছে। তাই কেউই শান্তিতে নেই। শুধু আমি না, এই ঈদের মৌসুম গেলেই বেশির ভাগ লোক দোকান ছাড়বে। এই মার্কেটে দোকান পাওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু আপনি ঘুরে দেখেন অনেক দোকান খালি পড়ে আছে।
ড্যাফোডিল ফ্যাশন নামে একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী শাহ আলম জানান, ভারত থেকে যে পণ্য আমরা আনতাম সেটি এখন দ্বিগুণ টাকা দিয়ে আনতে হচ্ছে। আনার পর কাস্টমার নেই। কাস্টমার এলেও এত টাকা দিয়ে কিনতে চাচ্ছে না। আমরা আসলে খুবই বেকায়দায় আছি। একটি পার্টির সাথে কথা হয়েছে, হয়তো এই মাসেই দোকান ছেড়ে দেবে। গতকাল মাত্র একটি থ্রি পিস বিক্রি হয়েছে। আর আজকে এখন পর্যন্তও একটিও বিক্রি হয়নি। তিনি বলেন, শুধু আমরা নয়, পুরো মার্কেট ঘুরে দেখেন কী অবস্থা। সামনের একটি দোকান দেখিয়ে তিনি বলেন, দেখুন বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে। উনিও ছেড়ে দেওয়ার জন্য এই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। সামনের জারিন কালেকশান বিডিতে এই দোকান খালি হওয়ার বিজ্ঞপ্তি ঝুলতে দেখা গেছে।
রাজধানীর গুলশান, বনানী, বিমানবন্দর, উত্তরাসহ প্রায় বেশির ভাগ এলাকার মার্কেটের চিত্রই এখন এমন। বিমানবন্দরের আশকোনা এলাকায় বড় শো রুম নিয়ে গার্মেন্টস আইটেমের দোকান খুলেছেন মাকসুদ আলম। তিনি জানান, করোনার লকডাউনের ক্ষতি এখনো পোষাতে পারিনি। এর মধ্যে সব কিছুর দাম বাড়ার কারণে কাস্টমার পেলেও দাম বাড়ার কারণে দেখে চলে যায়। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না। দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলও কোনো কোনো মাসে উঠছে না। আবার কর্মচারীর বেতনও দিতে হয়। সব মিলিয়ে আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। জানি না কতদিন এটি চালিয়ে যেতে পারব।
এদিকে, ধানমন্ডির সানরাইজ প্লাজার ‘নিউ জামদানী প্যালেসে’র মো. রায়হান বলেন, করোনার পরের বছর বেচাকেনা অর্ধেকে নামলেও এ বছর তা আরও কমে গেছে। তিনি বলেন, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। দাম বেড়েছে, ফলে বিক্রি একেবারে কম। এখন দুপুর ৩টা ২ মিনিট এ পর্যন্ত কোনকিছুই বিক্রি হয়নি। বৃহস্পতি, শুক্র, শনিবার বেচাকেনা কিছুটা হয়। এ সময় অন্য বছরগুলোতে ফাল্গুনের জন্য পণ্য আনা হতো, এবার সেটা আনা হয়নি।
রাপা প্লাজার বিসমিল্লাহ শাড়িসর মো. নুরুন্নবী বলেন, করোনার পর বেচাকেনা মোটামুটি ভালো চলছিল। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে যেহেতু অবস্থা খারাপ, সে কারণে খারাপ অবস্থায় আছে মধ্যবিত্তরা। তারা হয়তো কিনতে পারছে না। অনেক মালিক দোকান ছেড়ে দিয়েছেন। আগে যেখানে ১৫ জন কর্মচারী ছিল, এখন সেখানে আছে ছয় জন। নীল আঁচল শাড়িস এর মো. ফারুক আহমেদ বলেন, ক্রেতা নেই বেচবো কার কাছে। জিনিসপক্রের দাম বেড়েছে। এই আমিই কবে যে গরুর মাংস কিনেছিলাম মনে নেই।
ক্যাটস আইয়ের ম্যানেজার মোশারফ হোসেন সম্রাট বলেন, বেচাকেনা তুলনামূলক কম। ৩০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেওয়ার পরেও বেচাকেনা নেই।
‘ই-টুলিপ’-এর বিক্রয়কর্মী লাকি বলেন, গত বছর এই দিনে বেচাকেনা ভালোই ছিল এ বছর পুরো মার্কেটের অবস্থা খারাপ। আমাদের মালিক মাঝেমধ্যেই এই দোকান পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চান। সবকিছুর দাম বেড়েছে, আমরা যেখান থেকে প্রোডাক্ট আনি, সেখান থেকে আমাদের বেশি দামে কিনে আনতে হয়। সে কারণে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণেও ক্রেতাও কমছে।
নাফিসা ফ্যাসনের ইকবাল হোসেন বলেন, আগের থেকে বেচাকেনা খুব খারাপ। করোনার আগে যে অবস্থা ছিল সেটি আর ফেরেনি। আর কে সুজের স্বত্বাধিকারী বশির উদ্দিন মাকের্টে বেচাকেনা কমে যাওয়ার পেছনের কিছু কারণ উল্লেখ করে বলেন, ডলারের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে টাকার দাম কমে গেছে। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। এখন ধানমন্ডি, লালমাটিয়ার মানুষও হিসেব করে চলছে। অনলাইনে সৌখিন ব্যবসায়ীরা ঝামেলা বিহীন সহজে ব্যবসা করতে পারছে। ফলে তারাই এখন আসল ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। আর আমরা যারা দোকান নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা লগ্নি করেছি, তারাই প্রান্তিক হয়ে গেছি।