খেলাধুলা যে কূটনীতির মাধ্যম হতে পারে, সেটি আবারও প্রমাণিত হলো। বিশেষ করে ফুটবল কূটনীতি বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনাকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। ফুটবল এমন একটি খেলা, যেটি সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের এক জায়গায় নিয়ে আসতে পারে। বিশ্বকাপ ফুটবল হলে তো কথাই নেই। এজন্য বিশ্বকাপ ফুটবলকে বলা হয় ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু হলে প্রায় এক মাস ফুটবলপ্রেমীরা খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। পছন্দের দলকে সমর্থন করে সেই দেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো, প্রিয় দলের জার্সি কেনা ইত্যাদি সাধারণ ব্যাপার। কোনো কোনো সময় খেলাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। অবশ্য এই লেখায় আমি সে ধরনের নেতিবাচক কিছু লিখতে চাই না। এবারের বিশ্বকাপ-পরবর্তী যে বিষয়টি সবার নজর কেড়েছে, তা হলো ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস খোলা।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু পেছনে ফেরা যাক। ২০১২ সাল। সেবারের গণিত অলিম্পিয়াডের আসর বসছে আর্জেন্টিনায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা পড়েছেন বিপাকে। আর্জেন্টিনার ভিসা করাতে ছুটতে হচ্ছে সেই দিল্লিতে। কারণ, বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার দূতাবাস নেই।
অবশেষে এ রকম সমস্যার সমাধান হলো। ঢাকায় আবার চালু হলো আর্জেন্টিনার দূতাবাস। আর এই দূতাবাস খোলার পেছনে আছে ফুটবল কূটনীতির অসাধারণ এক গল্প। বাংলাদেশ জুড়ে বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনা সমর্থকদের উন্মাতাল সমর্থন দেশটিকে বাধ্য করেছে ঢাকায় দূতাবাস খুলতে। আর বাংলাদেশি এই আর্জেন্টিনা সমর্থকদের উন্মাদনা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমরা এক অনন্য ঘটনার জন্ম দিয়েছি।
২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ভেন্যুতে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভেন্যু তিনটি হলো টিএসসি, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ও মুহসীন হলের মাঠ। এর মধ্যে মুহসীন হলের মাঠে খেলা দেখার আয়োজন নিয়ে আন্তর্জাতিক হইচই শুরু হয়ে যায়। বিশ্বের নামকরা সব সেলিব্রিটি এই মাঠের ছবি পোস্ট করছেন টুইটারে, ফেসবুকে।
আর্জেন্টিনার মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় এ খবর। খোদ দলের কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি এবং পরে লিওনেল মেসিও এ নিয়ে কথা বলেন। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের উৎসবে উড়তে থাকে বাংলাদেশের পতাকা। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে বাংলাদেশের সম্পর্ককে অন্য স্তরে নেওয়ার কথা বলেন। এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতিকে বিশ্বকাপ জয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে দূতাবাস খোলার আহ্বান জানান। আর সেই থেকেই এখন ঢাকায় দেখা গেল আর্জেন্টিনার দূতাবাস।
দেশের তারুণ্যের সামনে খেলাধুলাকে তুলে ধরতে সব সময় চেষ্টা চালিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। খেলা নিয়ে তরুণদের ব্যস্ত থাকার মানে হলো, তারা মাদক-সন্ত্রাস থেকে দূরে থেকে নিজেদের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে পারবেন। সে জন্যই আমরা বিশ্বকাপকে সবার কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলাম। হতে পারে বাংলাদেশ এখন ফুটবলে পিছিয়ে। কিন্তু সবাই স্বপ্ন দেখে একটা সময় বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপে নিজের দেশের জন্যই চীৎকার করবে। আর সেই স্বপ্নটা বড় করার জন্য ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করাটা বড় একটা কাজ। ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা দেশের গণ্ডি পার হয়ে যে দূতিয়ালির জায়গায় পৌঁছে যাবে, এটা কল্পনাও করেননি অনেকে।
একমাত্র খেলাধুলাই পারে একটি জাতিকে উজ্জীবিত করতে। মাদক, সন্ত্রাস ও সমাজের অন্যান্য সমস্যা থেকে তরুণ সমাজকে দূরে রাখতে পারে একমাত্র খেলাধুলা। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার গত কয়েক বছর ধরে খেলাধুলাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুফল পেতে শুরু করেছি। ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস খোলার পেছনে তরুণ সমাজের যে উন্মাদনা দেখেছি, তা ভোলার নয়। শুধু ফুটবল সামনে রেখে বাংলার তরুণ সমাজ এক কাতারে এসেছিল—এটাই বা কম কীসে!
খেলা নিয়ে বাংলাদেশ আর আর্জেন্টিনার মধ্যে শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে তা নয়, ক্রীড়াঙ্গনে দূতিয়ালির ঘটনা এর আগেও অনেক ঘটেছে। অতীতের বিভিন্ন সময়ে খেলাধুলা নিয়ে নানা কূটনীতি হয়েছে। বৈরী দুটি দেশের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করেছে এই কূটনীতি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পিংপং বল কূটনীতির কথা অনেকের হয়তো স্মরণ থাকবে। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ান যুদ্ধে জড়ানোর পর পরিস্থিতি পালটে যায়। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অবশ্য এই যুদ্ধ চলাকালে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে অবরোধ দেয়। তখন ব্যাপক উত্তেজনা চলছিল বিশ্বব্যাপী। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও করেছিলেন কেউ কেউ। কোরিয়া যুদ্ধে চীন, উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করেছিল। ঐ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বৈরী। দুই পক্ষই সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা যায়। অবশেষে সেই সুযোগ এলো ১৯৭১ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস দল জাপান সফর করছিল। এ সময় চীনের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, ‘প্রথমে বন্ধুত্ব, এরপর প্রতিযোগিতা’। সে অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস টিম চীন সফর করে। ইতিহাসের পাতায় এটি পিংপং কূটনীতি নামে পরিচিত।
ক্রীড়া কূটনীতি একটি অনন্য শব্দ। খেলাধুলার অনন্য শক্তি মানুষ, জাতি ও সম্প্রদায়কে ভালোবাসার মাধ্যমে কাছাকাছি আনতে পারে? খেলাধুলার শক্তি কখনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ২১ শতকে বিশ্বায়নের এজেন্ডা থেকে জাতি-রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা, আত্মদর্শন ও পশ্চাদপসরণ থেকে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছে। তবে ফুটবল ও ক্রিকেট কীভাবে একটি কূটনৈতিক ধারা এগিয়ে নিয়ে দুটি আলাদা দেশ কিংবা জাতিকে এক করতে পারে, সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক।
ইউরোপের কথাই ধরা যাক। ফুটবলের রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউরোপীয় দেশ তাদের নিজস্ব পরিচয়ের পরিবর্তে ইউরোপীয় বলতে পছন্দ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় ফুটবলে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ফুটবলও রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়। ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে অতীতে নানা রাজনৈতিক দলের সমর্থক থাকলেও এখন তা নেই। এখন রাজনীতি বাদ দিয়ে তারা এক কাতারে। বিভিন্ন চ্যাম্পিয়ন ট্রফির আয়োজন হচ্ছে। প্যারিসের ক্লাব যাচ্ছে লন্ডনে। আবার স্পেনের ক্লাব যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এ ধরনের লিগ আয়োজনের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলোর পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হয়েছে।
এবার আসা যাক ক্রিকেটে। ১৯৬৯ সালে বর্ণবাদের অভিযোগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের হয়ে একজন কালো খেলোয়াড়কে খেলার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। পরে নানা তৎপরতায় ঐ খেলোয়াড় খেলার অনুমতি পেয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৪ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট সফর পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে উভয় পক্ষ একে অপরের জন্য তাদের কঠোর ভিসা প্রবিধান শিথিল করেছিল এবং হাজার হাজার ভক্তকে সীমান্তের ওপারে ভ্রমণ করার অনুমতি দেয়।
এছাড়া জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০৫ সালে একটি ক্রিকেট ম্যাচের জন্য ভারতে এসেছিলেন। ট্রিপটি দ্রুত একটি শীর্ষ সম্মেলনে রূপ নেয়। কারণ উভয় পক্ষকে ‘কাশ্মীর নিয়ে তাদের বিরোধের অবসান ঘটানোর একটি ঐতিহাসিক সুযোগ কাজে লাগাতে’ আহ্বান জানানো হয়েছিল।
২০০৮ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড জিম্বাবুয়ের ২০০৯ সালের ইংল্যান্ড সফর বাতিল করে এবং ২০০৮ সালে জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসংক্রান্ত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থগিত করে। সংসদ সদস্য জ্যাক স্ট্র ও টেসা জোয়েল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের কাছে চিঠি লিখে জিম্বাবুয়েকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানান। দেখা যাচ্ছে, খেলাধুলায় কূটনীতি সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।