সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর বলেছেন, আমরা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই। সম্প্রতি ইইউর অনুসন্ধানী মিশন বাংলাদেশ সফর করেছে এবং তারা ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দেবেন। এরপর জোসেপ বোরেলই সিদ্ধান্ত নেবেন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কি না। গতকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
এদিকে গতকাল সফরের দ্বিতীয় দিনে ব্যস্ত সময় পার করেন ইইউর বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, আসন্ন নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা ইস্যুতে আলোচনা করেন।
ইমন গিলমোরের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু অন্য রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এটি সম্পূর্ণভাবে তাদের বিষয়। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি এবং নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচন কমিশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বয়স খুব বেশি দিনের নয় এবং এর সীমাবদ্ধতা ইইউ নেতৃত্ব ভালো করে জানেন ও বোঝেন। ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের গত ৫০ বছরে যে বলিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেটির ওপর নির্ভর করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও শক্তিশালী হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে।
দেশে গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যা কমেছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
দেশে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অনেক কমে গেছে বলে ইইউ মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোরকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল সচিবালয়ের নিজ দপ্তরে গিলমোরের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছেন। তাদের জানিয়েছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেমন সবকিছুতে উন্নতি হয়েছে, তেমনি মানবাধিকার নিয়ে অনেক কাজ করা হচ্ছে। এখানে মানবাধিকার কমিশন রয়েছে, তারা স্বাধীন।
গুম, খুন ও বিরোধী দল যে হয়রানিমূলক মামলার অভিযোগ করেছে, তা নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এগুলো নিয়ে বিশেষ কোনো কথা হয়নি। তারা বলেছে পর্যবেক্ষণ করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গুমের ইতিহাস আমরা যতটুকু জানি, যারা আত্মগোপন করে বিভিন্নভাবে, তাদের সম্পর্কে আমরা জানি। আবারও বলেছি, গুমগুলোর বেশির ভাগই ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা দণ্ডের ভয়ে পালিয়ে বেড়ান। কিংবা পারিবারিক সমস্যার কারণে তারা পালিয়ে বেড়ান। কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে লোকসান দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
নির্বাচন নিয়ে কী জানতে চেয়েছেন প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন ইউরোপীয় প্রতিনিধিরা। তাদের জানিয়ে দিয়েছি, সংবিধান অনুসারে নির্বাচন হবে। তবে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া। এজন্য তিন মাস নির্বাচন কমিশন সরকার পরিচালনা করবে। সরকার মানে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নির্বাচন পরিচালনা করতে যা যা প্রয়োজন, তা নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে করতে পারবে। নির্বাচন নিয়ে তারা কী বলেছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা এতটুকু বলেছেন—আমরাও আশা করি, একটি সুন্দর নির্বাচন হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ নিয়ে ইইউ উদ্বিগ্ন
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ নিয়ে ইইউ উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন ইইউর মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর। গতকাল সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে তার দপ্তরে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই উদ্বেগের বিষয়ে জানান তিনি।
গিলমোর বলেন, বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। এ আইনের প্রয়োগ নিয়ে ইইউ উদ্বিগ্ন। বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আমাকে নিশ্চিত করেছেন, আইনটি সংশোধনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা আইনটি প্রকাশের অপেক্ষায় আছি। প্রকাশ হওয়ার পর আইনটি বিস্তারিত পরখ করে দেখব।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হচ্ছে। সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে সংশোধন আনছে, তাতে সাংবাদিকেরা খুশি হবেন। বৈঠকে উপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়েও কথা হয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে বলেছি, এটি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে একবার বৈঠক করার পর আবার একটা খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আবারও অংশীজনদের সঙ্গে বসা হবে বলে আমি আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি।’
শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের বলেছি, বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার জোরদার হয়েছে। এটি নিয়ে অনেক কাজ করেছি এবং করে যাচ্ছি। যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো দূর হবে বলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে আশা ব্যক্ত করেছি। সেখানে ইইউর সহযোগিতা চেয়েছি।’
আনিসুল হক বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বিশেষ কোনো আলাপ হয়নি। নির্বাচন নিয়ে তাকে কেবল বলেছি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে যে আইনটি আমরা করেছি, এটি এই উপমহাদেশে প্রথম। আমরা আইন করেছি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য।
মানবাধিকার উন্নয়নে বাংলাদেশের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে ইইউ
মানবাধিকারের আরো উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ইইউ। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) ইইউর বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়ার মধ্যে বৈঠকে এ মন্তব্য করা হয়েছে। সরকারি সূত্র জানায়, বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশে মানবাধিকার উন্নয়ন, আগামী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠানো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও শ্রম আইন প্রধানত আলোচনায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ইইউ বিশেষ প্রতিনিধিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন।
মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ইইউর উদ্বেগ
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ইইউর উদ্বেগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইমন গিলমোর। গতকাল সকালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। গিলমোর বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে ইইউর। মানবাধিকার ইস্যুতে আমরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছি। তারা সরকারি পর্যায়ে কথা বলবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম নিয়ে কাজ করছে কমিশন। এসব ঘটনা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বিদেশিদের কাছে ভাবমূর্তি নষ্ট করে। নির্বাচন নিয়ে তেমন কিছু আলোচনা হয়নি। তবে নির্বাচনে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে আমাদের দেশের ইমেজ নষ্ট হয়।’