গবেষণায় চিন্তার বৈচিত্র্য থাকা দরকার। গবেষণার ক্ষেত্রে কোনো একটি বিষয়কে সবাই একইভাবে চিন্তা করবে, সেটি নয়, বরং গবেষণার কোনো একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গবেষকরা ভিন্ন ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারেন। গবেষণার অনেক বিকল্প পথ থাকে, সব গবেষক একই পথে হাঁটবেন তা নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন পথে হেঁটে গবেষণার সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করাই গবেষকদের মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার। আবার কখনো কখনো গবেষকরা বিদ্যমান বিকল্প পথে না হেঁটে নতুন নতুন পথের সন্ধান দেন, যা আগের সব চিন্তাধারা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন হয়। এমন একটা অবস্থা থেকেই মৌলিক গবেষণার জন্ম হয়। হাইড্রোজেন স্টোরেজ করে কীভাবে এনার্জির ক্রাইসিস সমাধান করা যায়, তা নিয়ে সারা পৃথিবীর গবেষকরা গবেষণায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। সবাই হাইড্রোজেন স্টোরেজের পদ্ধতি নিয়ে একইভাবে ভাবছেন না, যদিও সবার লক্ষ্য একটাই, তা হলো হাইড্রোজেন স্টোরেজ কীভাবে বাড়ানো যায়। পরীক্ষাগারে গবেষণার আগে গবেষকরা থিওরিটিক্যাল রিসার্চ করে বোঝার চেষ্টা করছেন হাইড্রোজেন স্টোরেজ বাড়ানোর জন্য কোন কোন বিষয়গুলো ভূমিকা রাখতে পারে। খুব বড় করে দেখলে হাইড্রোজেনকে চার ভাবে স্টোরেজ করা যায়, যেমন—জিওলজিক্যাল হাইড্রোজেন স্টোরেজ, লিকুইডিফাইড হাইড্রোজেন স্টোরেজ, কম্প্রেশড হাইড্রোজেন স্টোরেজ ও ম্যাটেরিয়াল-বেসড স্টোরেজ। ম্যাটেরিয়াল-বেসড হাইড্রোজেন স্টোরেজ গবেষণার ক্ষেত্রে ম্যাটেরিয়ালকে পরখ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের গবেষকদের এই ধরনের গবেষণায় আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করা দরকার। কারণ পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গবেষণা করা না গেলে পিছিয়ে পড়তে হবে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে পরনির্ভরশীলতাও বাড়বে। সারা পৃথিবীতে মাইক্রোবিয়াল ফুয়েল সেল নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার খুবই সীমিত আকারে হয়েছে। এর কারণ হলো, এখানে যেমন অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি অনেক সম্ভাবনাও আছে। মাইক্রোবিয়াল ফুয়েল সেল নিয়ে আমাদের দেশে গবেষণার অনেক সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের শিল্পকারখানাগুলোর ওয়েস্ট ওয়াটারের মধ্যে মাইক্রোঅরগানিজম বা অণুজীব থাকে। এই প্রযুক্তি অনুসারে, অণুজীবগুলো একই সঙ্গে বর্জ্য জলকে যেমন শোধন করে, তেমনি জৈবপদার্থে সঞ্চিত রাসায়নিক শক্তিকে সরাসরি বৈদ্যুতিক প্রবাহে রূপান্তর করে। বিকল্প গ্রিন এনার্জির উৎস হিসেবে এই ধরনের গবেষণায় গবেষকদের সম্পৃক্ত করা দরকার। আয়ন ব্যাটারি নিয়ে সারা পৃথিবীতে গবেষণা চললেও এর বিকল্প ব্যাটারি নিয়েও কাজ চলছে। এর কারণ হলো লিথিয়াম খনিজ পদার্থ হওয়ায় এক সময় এটি আর পাওয়া যাবে না। আকরিক খনন থেকে অস্ট্রেলিয়ায় লিথিয়াম সংগ্রহ করা হয়। আর্জেন্টিনা ও চিলিতে লিথিয়াম সংগ্রহ করা হয় সল্ট ডেসার্ট বা লবণাক্ত মরুভূমি থেকে যেখানে ভূগর্ভস্থ লিথিয়ামযুক্ত লবণাক্ত পানি পৃষ্ঠে এনে বাষ্পীভূত করার মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কারো কারো মতে, ২০২৬ সালে লিথিয়াম দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া এর মূল্য অনেক বেশি ও এখানে বিষাক্ত উপাদান থাকায় তা মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে গবেষকরা নেক্সট জেনারেশন ব্যাটারি হিসেবে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, গ্রাফেন, ম্যাঙ্গানিজ হাইড্রোজেন, সি-ওয়াটার, সলিড স্টেট হাইড্রোজেনসহ এ ধরনের নতুন নতুন মেটেরিয়ালকে ব্যাটারি হিসেবে বিবেচনায় আনছেন। ব্যাটারির ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ব্যাটারির ধারণাকে গবেষণায় প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। একেক গবেষক একেকভাবে তাদের গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। তবে সবার মূল উদ্দেশ্য হলো, সবক্ষেত্রেই সর্বোত্তম ফলাফল নিশ্চিত করা। যেমন সেপারেটরের মূল দুর্বলতা হলো আয়ন এক্সচেঞ্জের মাধ্যম হিসেবে এটি ব্যবহৃত হওয়ায় দ্রুত ক্ষয় হয়ে যায় ও তার মেকানিক্যাল প্রপার্টি ধরে রাখতে পারে না। গবেষকদের চ্যালেঞ্জ হলো সেপারেটরের মেকানিক্যাল প্রপার্টি বাড়িয়ে কীভাবে এর আয়ন এক্সচেঞ্জ ক্ষমতাকেও বাড়ানো যায় ও এর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় হওয়া রোধ করা যায়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সবগুলো উপাদান যখন একত্রিত করা হবে তখন ব্যাটারির কার্যক্ষমতা বাড়াতে কেমিক্যাল কম্প্যাটিবিলিটি বা রাসায়নিক উপযোগিতা কীভাবে বজায় রেখে সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়া যায়। তবে এগুলোকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা যেমন রয়েছে, তেমনি সম্ভাবনাও রয়েছে। ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার চেষ্টা গবেষকরা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ব্যাটারির এনার্জি ডেনসিটি, চার্জ ও ডিসচার্জ এফিসিয়েন্সি ও সাইকেল লাইফ বাড়াতে ন্যানোটেকনোলজি বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফুয়েল সেলকে আরও টেকসই করতে ও এর কার্যকারিতা বাড়াতে ন্যানোটেকনোলজিকে গবেষকরা বিভিন্নভাবে ব্যবহারের পথ খুঁজে বের করে চলেছেন, যাতে করে হাইড্রোজেন ফুয়েলকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। গবেষকরা নতুন নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করে এই ম্যাটেরিয়ালগুলো তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
যেখানেই চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেখানে গবেষকদের কাজ করার সুযোগ সৃষ্টিতে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। ল্যাবরেটরিগুলো বিশ্বমানের করার দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে ম্যাটেরিয়াল তৈরি ও এনার্জি স্টোরেজ করার পরে এগুলোর এনালাইসিসের জন্য যে যন্ত্রগুলো রয়েছে তা আমদানিনির্ভর হওয়ায় পরীক্ষানিরীক্ষা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় উপাদান ব্যবহার করে এনালাইসিস-সংক্রান্ত্র যন্ত্রগুলো দেশে তৈরি করে যায় কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোরও এই ধরনের গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার মানসিকতা সবার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের পাঠ্যসূচিতে গবেষণার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনানির্ভর আধুনিকতম বিষয়গুলোকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য বাস্তবভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন ঘটাতে হবে। মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তির দ্রুততম পরিবর্তন ঘটানোর বার্তা নিয়ে এসেছে। এখন আর আমাদের পিছনে পড়ে থাকলে চলবে না বরং উন্নত বিশ্বের সঙ্গে গবেষণায় প্রতিযোগিতা করে প্রকৃত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই হয়তো আমাদের দেশ একদিন সারা পৃথিবীর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সূতিকাগারে পরিণত হবে। তখন গবেষণা হয়ে উঠবে অর্থনীতির মূলশক্তি।