দেশে নিত্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যের দাম বেড়েছে। বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে চাপ বাড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। সরকারি সংস্থা পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যই বলছে, মার্চে গড় মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পেয়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ হয়েছে। যদিও ঐ সময়ে আটা, ডিম ও মাংসের মতো নিত্যপণ্যের দাম ছিল গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় তিন গুণ। আর গড়ের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল ওষুধসহ স্বাস্থ্যসেবায়। জীবনধারণ কিংবা পুষ্টি গ্রহণের প্রধান খাদ্যপণ্য এবং চিকিৎসার মতো মৌলিক সেবায় অস্বাভাবিক এ মূল্যস্ফীতির তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে। সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মার্চে গম বা আটায় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগের চার মাস অর্থাৎ নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে আটায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩০ শতাংশেরও বেশি। যদিও ঐ সময় দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশের কম। যেমন গত ডিসেম্বরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ থাকলেও আটার ক্ষেত্রে সেটি ছিল ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ। চালের পরে আটাই দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য হিসেবে স্বীকৃত। আটা ছাড়াও অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ঘটেছে আমিষের প্রধান উত্স ডিম ও মাংসের ক্ষেত্রে। ২০২২ সালের মার্চে ডিম ও মাংসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর চলতি বছরের মার্চে আমিষের এ দুটি মূল্যস্ফীতি ২৩ দশমিক ৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। খাদ্যপণ্যের মধ্যে মসলায় মূল্যস্ফীতির হার ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ভোজ্য তেলের মূল্যস্ফীতিও ১২ শতাংশের বেশি। এছাড়া অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের পণ্যবাজার অস্থিতিশীল। ভোগ্যপণ্য ছাড়াও বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে আটা, চিনি, ডিম, মাংস, মাছ, সবজি, ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ-তিন গুণও বেড়েছে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম কমছে না। বরং প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। কোনো রকমে বেঁচে থাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মাংস, ডিম, দুধের মতো আমিষজাতীয় পণ্যের দাম এখন দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। দরিদ্র মানুষ এমনিতেই পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এখন পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের অস্বাভাবিক দামের কারণে জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ আরো বেশি পুষ্টিহীন হিসেবে বেড়ে উঠবে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের শ্রমশক্তির উত্পাদনশীলতা কমে যাবে।
গোলাম রহমান বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষ সবার আগে চিকিত্সা ব্যয় কাটছাঁট করে। চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে মানুষ খাদ্য কেনে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। উল্টো সরকারকে ঋণ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ লাখ কোটি টাকার বেশি নতুন টাকা ছাপিয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি আরো উসকে উঠছে।
কোভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ২০২২ সালের শুরুতে তেতে ওঠে বিশ্বের পণ্যবাজার। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। অস্বাভাবিক হারে দাম বেড়ে যায় কয়লা, গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানি পণ্যের। একই সঙ্গে বাড়ে ভোজ্য তেল, গমসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামও। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অস্বাভাবিক পণ্য পরিবহন ব্যয়। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়ে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু গত ছয় মাসে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই মূল্যস্ফীতির চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কমতে কমতে ব্যারেলপ্রতি মাত্র ৭৫ ডলারে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে কোডিভপূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরেছে ভোগ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম এখনো অস্থিতিশীল। ফলে নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির হার।
বিবিএসের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরে দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ০২ শতাংশ, যা ২০১০-১১ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। ২০১০-১১ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পর থেকে মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে কমে ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে ৫ শতাংশে নেমে আসে। তবে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে থাকে।
সর্বশেষ জুনেও দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। গত মে মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুনে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। ফলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার আরো বেড়েছে। যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই মূল্যস্ফীতির হার কমে আসছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন)। তবে তা ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। দেশে গমের চাহিদার বেশির ভাগই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে বাংলাদেশ। যুদ্ধের কারণে সরবরাহ কমে গেলে বিশ্ববাজারের পাশাপাশি দেশের বাজারেও বাড়তে শুরু করে আটার দাম। তবে এরপর বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব খুব একটা পড়তে দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রতি টন গমের দাম ৪৯২ দশমিক ৪ ডলার হলেও তা ক্রমান্বয়ে কমে গত জুনে দাঁড়ায় ৩৪৫ দশমিক ৫ ডলারে।
তবে দেশের বাজারে এর চিত্র ভিন্ন। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৫ টাকায়। আর প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬০-৬৫ টাকা। গত বছরের এ সময়ে খোলা ও প্যাকেট আটার দাম ছিল যথাক্রমে ৪০-৪২ টাকা ও ৪৮-৫৪ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খাদ্যপণটির দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩০ ও ২২ শতাংশের বেশি।