গত কয়েক দিন ধরেই তাপমাত্রা রেকর্ড গড়ছে আর ভাঙছে। গণমাধ্যমের ভাষ্য মতে, এবারের বৈশাখের প্রথম সপ্তাহটি ঢাকার তাপমাত্রার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঘরের ভেতরে যারা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকছেন, তারা হয়তো বুঝতে পারবেন না। কিন্তু নানা কাজে যারা দিনে ঘরের বাইরে বের হয়েছেন, তারা টের পেয়েছেন গরম কাকে বলে। খোদ রাজধানীতে গত ৫৮ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত দুটি দিনের একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গত পহেলা বৈশাখ গ্রীষ্মের প্রথম দিনে ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ রেকর্ড ছুঁয়েছে। এ সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড গড়ে। এর আগে একবার ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকার তাপমাত্রার পারদ একই উচ্চতায় উঠেছিল। অর্থাৎ ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি ছুঁয়েছিল। এর আগে এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা উঠেছিল ১৯৬৫ সালে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ১৯৬০ সালে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ দেশে রেকর্ড তাপমাত্রার ধারেকাছেই বর্তমান তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করছে। আমাদের দেশে থেকে বৃষ্টি যেমন উধাও হয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিও ‘নেই’ হয়ে গেছে। দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, দফায় দফায় তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়ানো হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নানা স্থানে বিভিন্ন রকম অপকর্ম করছে, অথচ এসব নিয়ে কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই, আন্দোলন নেই, শাসকদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো কর্মসূচি নেই।
আর থাকবেই-বা কীভাবে? এই গরমে টিকে থাকাই যেখানে দায়, সেখানে আন্দোলন করে অকালমৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানাবে কোন আহাম্মক? আসলে এই গরমে আন্দোলন করা যায় না। আন্দোলনের জন্য একটা পরিবেশ লাগে। আমাদের দেশে সব আন্দোলনই জমাট বেঁধেছে শীতকালে। কারণ ঠান্ডামাথা শীতল পরিবেশ ছাড়া কখনো আন্দোলন হয় না। বর্তমানে পরিবেশ একেবারেই বিগড়ে গেছে। এখন প্রতিদিন যে সূর্য উঠছে, সে তো যেন জ্বলন্ত চুল্লি। বাতাস তো নয়, যেন ‘লু’ হাওয়া।
অতিরিক্ত গরম ও তাপপ্রবাহের কারণে আমরা কেবল হাঁসফাঁস করছি। সবার মুখে একটাই কথা: উফ্ফ্ কী গরম! জ্বলে গেলাম, পুড়ে গেলাম! মরে গেলাম! এত গরম বাপের জম্মে দেখিনি! আসলে গরম নিয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। যেমন নেই মূল্যবৃদ্ধি, ক্ষমতাসীনদের ঔদ্ধত্য, কিংবা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি নিয়ে কিছু করার! যেন ‘উহা অনিবার্য, চলিতেই থাকিবে! বেশি তাপে যে কোনো কঠিন পদার্থই নাকি প্রসারিত হয়। আকার-আকৃতির পরিবর্তন হয়। বর্তমানে দেশে যা তাপ, তাতে অন্যসব কঠিন পদার্থ তো বটেই, মানুষের মগজও কেমন যেন ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। মাথার গন্ডগোল দেখা দিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারমারি, সংঘাত-সংঘর্ষ, সবই বেড়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে, মানুষজন তুচ্ছ কারণে খেঁকিয়ে উঠছেন। কাউকে ভাই বললেও প্রত্যুত্তরে শালা সম্বোধন শুনতে হচ্ছে। কুশল জিগ্যেস করলে এমন সব জবাব শোনা যাচ্ছে, যেন আপনি তার সম্পত্তি লিখে নেওয়ার প্রস্তাব করছেন! সবার মধ্যে তাপ, চাপ, মেজাজ। বস তার কলিগদের সহ্য করতে পারছেন না। অকারণে গালাগাল করছেন। গণপরিবহনে যাত্রীর সঙ্গে যাত্রীর, যাত্রীর সঙ্গে পরিবহন-শ্রমিকদের কথা কাটাকাটি, মারামারি, ঝগড়া বেড়ে গেছে। পরিবারগুলোতেও আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের মতো আত্মঘাতী সংঘাত বেড়ে গেছে।
গরমে অতিষ্ঠ গিন্নিরাও টি-টোয়েন্টির ব্যাটসম্যানদের মতো মারমুখী হয়ে উঠেছেন। পান থেকে চুন খসলেই পুরুষ সদস্যরা যেমন খেঁকিয়ে উঠছেন, নারীরাও পালটা আঘাত হানছেন। এতে করে ঘরে ঘরে দাম্পত্য কলহ বাড়ছে। সবাই এখন সবকিছুর দায় চাপাচ্ছেন গরমের ওপর।
যেমন, এক ক্রেতা দোকান থেকে এক ডজন ডিম কিনেছেন। কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখেন ডিমের সংখ্যায় গড়বড়।
ক্রেতা ক্রুদ্ধ হয়ে সেই দোকানে এসে দোকানদারকে বলছেন, আমি এক ডজন ডিম কিনে নিয়ে গেলাম। বাসায় গিয়ে দেখি তুমি ১১টা ডিম দিছ। এই জোচ্চুরির মানে কী? তুমি কি মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি, যে এক ডজন ডিমে ১টা কম দিবা? বিক্রেতা কাঁচুমাচু হয়ে বলছেন, স্যার, যা গরম পড়ছে, তাতে মাথামুথা ঠিক নাই, বারোডার জায়গায় ভুল করে এগারোটা দিয়া দিছি। ক্রেতা ভদ্রলোক রাগত কণ্ঠে বলেন, কিন্তু বারোটার জায়গায় তেরো কিংবা চোদ্দোটা তো দিলা না! এবার দোকানি ভদ্রলোক বেশ একটা রহস্যের হাসি হেসে বলেন, স্যার, গরম পড়ছে ঠিকই, কিন্তু অত গরম কি আর পড়ছে যে বারোটার জায়গায় তেরোটা দিমু!
মানুষ গরমে হা-পিত্যেস করলেও আবহাওয়াবিদরা কোনো সুসংবাদ শোনাতে পারছেন না। তাদের ভাষ্যমতে, আপাতত বৃষ্টিপাত হওয়ার কিংবা গরম কমার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই! গরম কমবে কীভাবে? মৌসুমি বায়ু তো আর কারো আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী চলে না। উৎপন্নও হয় না। পুকুর নেই, ডোবা নেই, আছে শুধু মালটিস্টোরিড বিল্ডিং, শপিংমল, মালটিপ্লেক্স, ফুললি এয়ারকন্ডিশনড ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ভেড়ার পালের মতো বাড়ছে মানুষ, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি, বাড়ছে এসি, বাড়ছে জেনারেটর, বাড়ছে রেফ্রিজারেটর।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত কিন্তু চাহিদা প্রচুর। বিদ্যুৎ নেই? জেনারেটর চালাও। আরে বাবা সেও তো চলবে ডিজেলে। এদিকে পেট্রোলে, ডিজেলে ভর্তুকি দিতে দিতে সরকার ফতুর, এ অবস্থায় সরকার জ্বালানির দাম বাড়িয়েই চলেছে। এর প্রভাবে বাজার ও জিনিসপত্রও গরম হয়ে গেছে।
আসলে সুখে থাকতে মানুষকে ভূতে কিলায়। মানুষ বোঝে না এঁড়ে গরু টেনে দুধ দোয়ানো যায় না। ভুলে যায় প্রকৃতিকে ধ্বংস করলে প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নেয়। পৃথিবীতে সম্পদ সীমিত। গাছ কাটো, পুকুর বোজাও, নদী ভরাট করো, ফ্ল্যাট তোলো, এসি বসাও, জেনারেটর চালাও, ঘরে বসে বসে টিভি ওয়েব সিরিয়াল দেখো, খেলা দেখো, রেশমিকা মান্দানা কিংবা দীপিকা পাড়ুকোনের নাচ দেখো, আর হাইব্রিড চিকেন ফ্রাই কিংবা চিপস চিবোও, নয়তো ঠান্ডা পানীয় গেল। কিন্তু দুনিয়াটা তো আর মামাবাড়ির আবদার নয়! তাই তো মা বসুধা খেপে ব্যোম আমাদের ওপর। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বিরূপ হয়েছে, ভাগ্যদেবতা ওপরে বসে বসে হাসছেন।
বুদ্ধিজীবীরা বলেন, ‘গ্লোবাল ওয়ারমিং’-এর কথা। গ্রিনহাউজ গ্যাসের কথা। এগুলোর সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য নিহিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই তাপমাত্রা কমবে না। সময়ের বৃষ্টি সময়ে হবে না।
জ্ঞানী-গুণীরা অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন। তারা বলছেন, হে আদম সন্তানেরা, আপনারা বরং গরমকে এনজয় করতে শিখুন। অপ্রয়োজনীয় বৃষ্টিপ্রেমী পুতুপুতু স্বভাবের ঘর্মভীরু পাবলিকের খাতায় নাম লেখাবেন না। ওদের সবকিছুতেই অভিযোগ করা স্বভাব। রক্তে দ্বিচারিতা, মেরুদণ্ডে কনট্রাডিকশন। এদিকে টাকার গরম দেখলে যুগপৎ লালা ও দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, রূপের গরম দেখলে বলবে, ‘ধ্যুত, কী আচরণ!’ অথচ গরম দেখালেই তেড়ে গাল পাড়বে। কেন রে বাবা? এই সিজনটাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর! গরমকালটা সোশ্যালিস্টদের মতো।
সাম্যবাদী। হাভাতে থেকে এমপি, রিকশাওয়ালা থেকে মন্ত্রী, সবাইকে সমান জ্বালাবে। আই মিন তাপ দেবে আর কি। বর্ষার মতো ফিকল-মাইন্ডেড না, একদিকে জল জমল তো আরেক দিকে ফকফকা। গ্রীষ্মের একেবারে সাধু-সন্ন্যাসীর মতো স্বভাব। মন-মুখ এক, নির্বিকার। সকাল ৯টাতেও ঝাঁ-ঝাঁ করছে, দুপুর দুটোয়ও ঠা-ঠা। এমনকি রাত দুটোতেও চনচন!
এই যেসব রোগব্যাধি হয়, সেগুলোও অনেক স্মার্ট! গরমে চিকুনগুনিয়া, ডায়রিয়া, পেটের অসুখ কিছু হয় বটে।
কিন্তু সেগুলো আসলে গরমের রোগ নয়, বরং বলা যায় বাঙালির চিরকালীন অসুখ। গরমের প্রকৃত ব্যামো হচ্ছে হিট স্ট্রোক, সান-স্ট্রোক। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, ঠাস করে পড়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। কী সুন্দর যন্ত্রণাহীন! হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নেই, হাজারও ক্লিনিক্যাল টেস্টে জেরবার হওয়া নেই, নানা ধরনের বড়-পাঁচন গেলা নেই, ভেন্টিলেশন নেই, কেমো নেই, যন্ত্রণায় ছটফটানো নেই, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খসিয়ে পরিবারসুদ্ধ সবার অভিশাপ কুড়ানো নেই। ঘেমো ঋতুও এমন ঘ্যামা মৃত্যু নিয়ে আসে!
আর বেঁচে থাকলেও, এই গরমই আপনার মুশকিল-আসান। পৃথিবীর যত্ত ‘উদো’র যাবতীয় পিণ্ডি চাপাতে পারেন এই ‘বুধো’র ঘাড়ে। গার্লফ্রেন্ড অতিমাত্রায় ন্যাকামো করছে? গুছিয়ে গালাগাল দিন। পরে মেসেঞ্জারে বললেই হলো, সরি, ইট ওয়াজ টু হট দ্যাট ডে (আটাশটা ইমোটিকন জুড়তে ভুলবেন না)! বসের প্রতি অনেক দিনের রাগ এরিয়ার, ক্যারিয়ার পাচ্ছেন না? একটা ঝনঝনে গরমদিনে স্যাটাস্যাট স্ট্রেট-ব্যাটে ঝেড়ে দিন আপনার মতো তেলবাজ আর চতুর হতে পারলে আমিও অনেক ওপরে উঠতে পারতাম! পরে মেইল করুন : দ্য ননসেন্স ওয়েদার টুক আ টোল অন মাই সেন্সেস! সরি বস, হোপ, ইউ উইল ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মি!
কোনো ‘হৃদয়ের রানি’কে প্রোপোজ করে প্রত্যাখ্যাত? পরের দিন কোনো একটা ওছিলায় হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে বলুন, উফ্ফ্ এই গরমে কাল কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আর তুমিও যেমন, ফান বোঝো না! বাগানের সব গাছের লিচু প্রকাশ্যে পেড়ে খাওয়া, পর্নোসাইট বন্ধ করতে গিয়ে ফ্রিল্যান্স কাজের সাইট বন্ধ করে দেওয়া, আবার খোলা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, বউকে মাটিতে পুঁতে ফেলা, কাজের মেয়েকে মেরে ফেলা, মিথ্যে মামলা দিয়ে কাউকে ফাঁসানো—সবটাই আসলে এফেক্ট অব ব্লাডি সামার। এই গরমে মাথা ঠিক থাকে? জীবনের সব হোঁচট, হেঁচকি, আছাড়, ঠোক্কর, ছ্যাঁচরামি, নষ্টামি, ঢোক, ঢেকুরের সঙ্গে মিশিয়ে নিন গরমকে। বেইজ্জতি থেকে বাঁচবেন!