হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর পরেও ফিলিস্তিনের গাজায় নৃশংসতা বন্ধ করেনি ইসরাইল। দিনরাত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। শুক্র ও শনিবারে হামলায় শিশু-নারীসহ অর্ধশতাধিক লোক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ইসরাইলি বাহিনী দাবি করেছে, গাজায় তারা হামাস নিয়ন্ত্রিত স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। হামাসের ঘাঁটি, ট্যাংক-বিধ্বংসী লঞ্চার ও বিভিন্ন অবকাঠামো ছিল ইসরাইলি বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু।
গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ওই দিনই পাল্টা আক্রমণ শুরু করে ইসরাইল। এর পর থেকে নির্বিচার হামলা চলছে। অবরুদ্ধ রয়েছে গাজা উপত্যকা। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় ৪ হাজার ১৩৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। নিহতদের মধ্যে শিশু ১ হাজার ৫২৪টি, নারী ১ হাজারের বেশি। ইসরাইল জানিয়েছে, হামাসের হামলা ও তাদের সঙ্গে সংঘষের্র ঘটনায় তাদের দেশে নিহত মানুষের সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ ছাড়িয়েছে, আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬২৯ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৬৩ সেনা ও পুলিশ সদস্য।
রাফাহ সীমান্তে ত্রাণবাহী ট্রাক: এদিকে চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবার পর প্রথমবার ত্রাণ নিয়ে রাফাহ সীমান্তে ঢুকেছে কয়েকটি ট্রাক। টিভির ফুটেজে দেখা গেছে, মিসর থেকে ট্রাকগুলো সীমান্ত পার হচ্ছে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার প্রধান পথ হচ্ছে রাফাহ। মিসর সীমান্ত দিয়ে ট্রাকগুলো গাজার বাসিন্দাদের কাছে মানবিক ত্রাণ পৌঁছে দেবে। গাজায় ২৩ লাখ মানুষ বসবাস করে। হামাস বলেছে, ২০টি ট্রাকে ওষুধ, চিকিত্সা সরঞ্জাম, খাবার নিয়ে গাজায় ট্রাকগুলো ঢুকেছে। জাতিসংঘ গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে। সেখানে খাবার ও জ্বালানি শেষ হয়ে আসছে। হাসপাতালগুলোতে জেনারেটর চালানোও সম্ভব হচ্ছে না। মিসরে অবস্থানরত স্ট্রিংগারের বলেছে, ২০টি ট্রাক পৌঁছানোর পর সীমান্ত দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সকালে রাফাহ সীমান্ত খোলার সঙ্গে সঙ্গে মিসরীয় অংশের লোকেরা উল্লাস ও স্লোগান দিয়ে উদ?যাপন করে। জাতিসংঘের একটি সংস্থা বলেছে, এই ত্রাণের পরিমাণ গাজার প্রয়োজনীয় চাহিদার চেয়ে অনেক কম। যাকে ‘সাগরে এক বিন্দু পানি ফেলার’ সঙ্গে তুলনা করেছে। পানির পাম্পগুলোর জন্য জ্বালানি অপরিহার্য। গাজায় পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিছু জায়গায় পানি পুরোপুরি ফুরিয়ে গেছে।
লন্ডনে বিক্ষোভ: ফিলিস্তিনের গাজায় বেসামরিক লোকজনের ওপর ইসরাইলের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে লন্ডনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন লাখো মানুষ। শনিবার সেন্ট্রাল লন্ডনের পোর্টল্যান্ড স্ট্রিট ব্রিটিশ ব্রডকাস্টি করপোরেশন অফিসের সামনে থেকে পোর্টল্যান্ড স্ট্রিট, রিজেন্ট স্ট্রিট, পিকাডোলি স্কয়ার, হে-মার্কেট, ট্রাফলগার স্কয়ার, হোয়াইটহল ও পার্লামেন্ট স্ট্রিট, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে কমপক্ষে ১ লাখ মানুষ বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এই বিক্ষোভ সমাবেশে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশ নেন। লন্ডন শহরের বাসিন্দা ছাড়াও সারা যুক্তরাজ্য থেকে কয়েক শ বাস ভর্তি হয়ে অনেকে বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেন। একই দিন নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতেও বিক্ষোভ হয়েছে।
জ্বালানি প্রবেশ করবে না: ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, গাজায় জ্বালানি প্রবেশ করবে না। শুধু খাদ্য, পানি ও ওষুধ গাজায় সরবরাহ করা হবে। কিন্তু জ্বালানি সরবরাহ করা হবে না। ড্যানিয়েল হাগারি ফিলিস্তিনিদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, মানবিক কারণে কেবল ত্রাণ পৌছানোর অনুমতি দেয়া হবে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব হবে এমন কোনো পণ্য পৌছাতে দেবে না।
শান্তি সম্মেলন: ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ বন্ধে মিসরের রাজধানী কায়রোয় শুরু হয়েছে শান্তি সম্মেলন। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বেশ কয়েকজন নেতা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। শান্তি সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য রেখেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেওয়া যাবে না। মাহমুদ আব্বাস আরও বলেন, আমরা কখনই স্থানান্তর মেনে নেব না, যত চ্যালেঞ্জই হোক না কেন আমরা আমাদের ভূমিতেই থাকব। মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান, অধিকৃত পশ্চিম তীর যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করে হামাস।
এর আগে মিশর ও অন্যান্য আরব দেশগুলো জানায় যে, যুদ্ধের মুখে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের তারা গ্রহণ করতে পারবে না, কেননা এর ফলে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে বিতাড়নের সমান হবে। কায়রোতে শুরু হওয়া শান্তি সম্মেলন জর্ডান, কাতার, ইতালি, স্পেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। তবে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের কোনো প্রতিনিধি সেখানে নেই।
মার্কিন মা-মেয়েকে মুক্তি দিল হামাস: জিম্মি করে রাখা দুই মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে হামাস। তারা হলেন জুডিথ রানান (৫৯) ও তার মেয়ে নাতালি রানান (১৭)। গতকাল শনিবার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। ইসরাইলে হামলার পর যে ২০০ জনকে জিম্মি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে এই প্রথম দুইজনকে মুক্তি দিলো হামাস। মুক্তির পর মার্কিন দুই নাগরিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। কাতারের মধ্যস্থতায় ২১ অক্টোবর অজ্ঞাত স্থান থেকে তারা মুক্তি পান। দুই মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দেওয়ার পর হামাস বলেছে, কাতারের প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় ‘মানবিক কারণে’ ওই দু’জনকে মুক্তি দিয়েছে তারা
হাসপাতাল ফাঁকা করার নির্দেশ: গাজার আল কুদস হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক হাজার বেসামরিক মানুষ। তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল। এতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কয়েকটি মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ।