কক্সবাজারের টেকনাফে আত্মসমর্পণ করা ১০২ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবাকারবারির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ইয়াবা ও অস্ত্রের আলাদা দুটি মামলার রায় ২৩ নভেম্বর (বুধবার) ঘোষণার দিন ঠিক করা আছে। আত্মস্বীকৃতদের মধ্যে একজন কারাগারে মারা যাওয়ার পর ১০১ জনের বিরুদ্ধে রায় প্রস্তুত করা হয়েছে। ১৪ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন থাকলেও তা পরে ১৫ তারিখ করা হয়। সেদিনও রায় না হয়ে ২৩ নভেম্বর দিন দেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
আলোচিত এ মামলার রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো দেশ। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে আত্মস্বীকৃত এসব ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করার কথা রয়েছে।
এদিকে, রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাইসহ ৮৪ ইয়াবা কারবারি। এরমধ্যে অনেকেরই বিদেশে চলে যাওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। সাফাই সাক্ষ্য ও যুক্তি-তর্কের পর বুধবার (২৩ নভেম্বর) মাদক ও অস্ত্রের দুটি মামলার রায়ের দিন দিয়েছেন আদালত। গেল ১৫ নভেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এ দিন ধার্য্য করেন।
একইদিন আদালতে অনুপস্থিত ৮৪ আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আদালতের আদেশের পর আত্মগোপনে চলে যান শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা। যেখানে সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির চারভাইসহ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যন ও পৌরসভার কাউন্সিলরও রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, ৩০ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টেকনাফ থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) এবিএমএস দোহার সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে ১০২ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হয়। পরে দুই আসামির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
এদিকে, আদালতের আদেশের পর সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির চার ভাই আব্দুল আমিন, আব্দু শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম প্রকাশ শফিক, ফয়সাল রহমান, ভাগিনা সাহেদ রহমান নিপু এবং চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আলম, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আহম্মদের ছেলে বর্তমান চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান প্রকাশ জিহাদ ও তার বড় ভাই আব্দু রহমান, বর্তমান জেলা পরিষদ সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদের ছেলে দিদার মিয়া, টেকনাফ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল বশর প্রকাশ কাউন্সিলার নুরশাদ, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের এনামুল হক প্রকাশ এনাম মেম্বারসহ ৮৪ জন আত্মগোপনে চলে গেছেন। জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় নাগরিক সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের সাধারণ জনগণ।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সরওয়ার কামাল বলেন, বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান আমাকে বলছেন যে তার বাবার চিকিৎসার জন্য কয়েকদিন কক্সবাজারের বাইরে থাকবেন। এ কারণে তিনি যতদিন অনুপস্থিত থাকবেন ততদিন প্যানেল চেয়ারম্যান জহির আহমেদ দায়িত্ব পালন করবেন। তবে একমাসের অধিক সময় যদি অনুপস্থিত থাকেন তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. জাহিদ ইকবাল বলেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
আদালত সূত্র জানায়, আত্মস্বীকৃত ১০২জন ইয়াবা কারবারিদের মধ্যে ১৭ জন করাগারে ৮৪ জন পালাতক এবং একজনের আগেই মৃত্যু হয়েছে কারাগারে। তবে রায়ের দিন পালাতক আসামিদের কেউ আদালতে উপস্থিত থাকবে না বলে স্থানীয় ও বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকে পালাতক থাকা ইয়াবা কারবারিদের একটি চক্র রায় পক্ষে নিতে বিচারককে কনভিজ করার কথা বলে জনপ্রতি কয়েক লাখ টাকা করে প্রায় তিন কোটি টাকা তুলেছেন, এমন আলোচনা চলছে টেকনাফ জুড়ে।
অভিযোগ উঠেছে, সাবেক এমপি আবদু রহমান বদির ভাই আত্মস্বীকৃত ইয়াবা মাফিয়া আবদুর শুক্কুরের নেতৃত্ব চক্রটি এসব টাকা তুলেছেন। আর টাকা জমা রেখেছেন বদির আরেক ভাই আত্মস্বীকৃত ইয়াবা মাফিয়া আবদুল আমিন।
স্থানীয় সূত্রে ও সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রায়ের তারিখ ঘোষণার পর আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে গোপনে দফায় দফায় বৈঠক করেন আবদুর শুক্কুর। এক পর্যায়ে রায় পক্ষে নেওয়ার কথা বলে জনপ্রতি ৩ লাখ টাকা করে তুলে ফান্ড করার সিদ্ধান্ত হয়। ক্যাশিয়ার নিযুক্ত হন আবদুর শুক্কুরের বড় ভাই আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি মাফিয়া আব্দুল আমিন।
তবে, নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এ দুই ভাইয়ের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, আলোচিত এ রায়কে ঘিরে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর, দেশবাসীর চোখ আদালতে- বিচারকের নামে ভাঙিয়ে অপপ্রচার করলেও রায় যা হবার হবেই।
পিপির মতে, মামলার মেরিট নিয়ে চিন্তা করলে তাদের কঠিন কোন শাস্তি নাও হতে পারে। তবে, তারা মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত বিষয়টি যেহেতু স্বীকৃত সেহেতু তাদের শাস্তি হবেই। আর শাস্তি নিশ্চিত বুঝতে পেরে হয়তো তারা আত্মগোপনে চলে গেছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সমাজ ও ইয়াবারিদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম বলেন, আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি যারা জামিন বাতিলের পর পালিয়ে আছে তাদের ধরতে কাজ করছে পুলিশ। আত্মগোপনে গেলেও শেষ রক্ষা হবে না তাদের।
আদালত সূত্রমতে, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা, ৩০টি দেশীয় তৈরি বন্দুক ও ৭০ রাউন্ড গুলিসহ আত্মসমর্পণ করেন ১০২ জন ইয়াবা কারবারি। টেকনাফ থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) শরীফ ইবনে আলম বাদী হয়ে মাদক ও অস্ত্র আইনে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক ২টি মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বপান পরিদর্শক এবিএমএস দোহা। ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট মোহাম্মদ রাসেল নামে এক আসামি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক তামান্না ফারাহর আদালতে ১০১ আসামির বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে মামলাটি বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল সব আসামির উপস্থিতিতে শুনানি শেষে মামলার চার্জ গঠন করেন। চলতি মাসের ১৫ নভেম্বর রায় হবার কথা থাকলেও সেদিন সব আসামির জামিন বাতিল করে ২৩ নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল।
অভিযোগ আছে, কারাগারে বসে ও জামিনে এসে অনেকে ফের ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে। এ কারণে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে সচেতন মহল।