গোয়েন্দাদের নিয়ে সমাজে অনেক কল্পকাহিনি প্রচলিত আছে। অনেকে তাদের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। তারা সবকিছু আগে থেকে জানেন, সব ঘটনার পেছনের কারণ বের করতে পারেন, একজন মানুষকে দেখলেই বুঝতে পারেন, তার উদ্দেশ্য ও চরিত্র—এমন কত কী!
বিভিন্ন গোয়েন্দা গল্প-উপন্যাস পড়ে আর সিনেমা, ওয়েব সিরিজ দেখে গোয়েন্দা বলতেই আমাদের মনে এমন একজন ব্যক্তির অবয়ব ভেসে ওঠে, যিনি দুর্ধর্ষ কায়দায় শত্রু শিবিরে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেন। তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে অসংখ্যবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে হয়। জীবনমৃত্যুর দোলাচলে তার প্রাণ পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে অনবরত, সময়ের ব্যবধানে সেই দোদুল্যমানতা বেড়ে যায়। জাতীয় স্বার্থের কাছে তার জীবনের মূল্য থমকে যায়, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রত্যাশা পূরণে তাকে সব বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়। অসংখ্য চিন্তায় তার মগজ কিলবিল করতে থাকে। শত্রুপক্ষের হাত থেকে বাঁচতে কিংবা অপারেশন সফল করতে মনের মধ্যে অসংখ্য ছক কষতে হয় তাকে। দিন শেষে সবকিছু পরিকল্পনামতো বাস্তবায়িত হলে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে ঘুমোতে যান তিনি। পরবর্তী মিশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
আসলেই কি গোয়েন্দারা এত চৌকশ হয়?
এ ব্যাপারে প্রথমেই একটি গল্প বলে নেওয়া যাক। আর্থার কোনান ডয়েল রচিত জনপ্রিয় রহস্য গল্পগ্রন্থ ‘দি অ্যাডভেঞ্চারস অব শার্লক হোমস’-এর বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস। তার সঙ্গী ছিলেন ডা. ওয়াটসন। গল্পটা তাদের নিয়ে। শার্লক হোমস ও ডা. ওয়াটসন বনের ধারে তাঁবুতে ঘুমাচ্ছিলেন। মাঝরাতে তাদের ঘুম ভেঙে গেল। শার্লক হোমস বললেন, ডা. ওয়াটসন, কী দেখতে পাচ্ছেন?
ওয়াটসন বললেন, রাতের আকাশ। আকাশে অনেক তারা।
এর মানে কী?
এর মানে হলো, আকাশ পরিষ্কার। আগামীকাল রোদ উঠবে। ঝকঝকে দিন আসবে।
না হয়নি।
তাহলে আপনি কী বুঝলেন, শার্লক হোমস?
আমাদের তাঁবুটা চুরি হয়ে গেছে!
আসলে আমরা গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় যে ধরনের গোয়েন্দা চরিত্রের সাক্ষাত্ পাই, বাস্তবে তেমন গোয়েন্দা খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। তার পরও কিন্তু গোয়েন্দাদের গুরুত্ব কম নয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ বিপুল অর্থ ব্যয় করে গোয়েন্দা পোষে। অধিকাংশ দেশেরই জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। এই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেমন দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদ দমন কিংবা বাইরের দেশের গুপ্তচরবৃত্তির ওপর কড়া নজরদারি চালায়, পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। অনেক সময় গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা বাইরের দেশে বিভিন্ন গোপন অভিযান পরিচালনার সংবাদও গণমাধ্যমের কল্যাণে শোনা যায়। যেমন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) কথাই ধরা যাক। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর যেসব দেশের সরকারকে তার জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি মনে করেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫৩টি গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনা করেছে সিআইএ। এর মধ্যে প্রায় ৩৫টি অভিযানে তারা সফলও হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মূল কাজ হচ্ছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য সরকারের নীতিনির্ধারকদের হাতে তুলে দেওয়া।
বিশ্বের সবচেয়ে চৌকশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে আমেরিকার সিআইএ, ইসরায়েলের মোসাদ, ব্রিটেনের এমআই-সিক্স, সোভিয়েত আমলের কেজিবি, ভারতের ‘র’ কিংবা পাকিস্তানের আইএসআই। গোয়েন্দা প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে যে, ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর খবর পত্রিকার পাতায় না আসার মানে হচ্ছে সেগুলো ঠিকঠাক নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে।’ সাধারণত একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কতটা দক্ষ তা নির্ভর করে সংকটকালে সেই সংস্থা কতটুকু সাফল্যের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে, তার ওপর।
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ইসরায়েলের মোসাদকে। ১৯৪৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ডেভিড বেন গুরিয়নের হাতে মোসাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেন গুরিয়ন ইসরায়েলে হিব্রু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা প্রদান করেছেন। ১৯৭২ সালে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামক ফিলিস্তিনি বিদ্রোহীরা মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ১১ জন ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদকে হত্যা করে। ঐ কর্মকাণ্ডে জড়িত একজন ফিলিস্তিনি বিদ্রোহী বাদে অন্যদের বিভিন্ন দেশে গিয়ে গুপ্তহত্যা করা ছিল মোসাদের লোমহর্ষক অপারেশন। কয়েক জন হামাস নেতাকে হত্যার অভিযোগও রয়েছে মোসাদের বিরুদ্ধে। পত্র-বোমা পাঠিয়ে হত্যা করার কৌশল প্রথম আবিষ্কার করে মোসাদ। এছাড়াও ইরাকের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়া এবং ইরানের দুই জন বিজ্ঞানীকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে মোসাদের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে মোসাদ ইসরায়েল রাষ্ট্রের ফুসফুস; দেশের ভরসা ও শত্রুদের সাক্ষাত্ যমদূত। সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র বাঁচানোর জন্য ইসরায়েল যেভাবে আয়রন ডোম ব্যবহার করে, তেমনি মোসাদ ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষায় ঢাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। তাই মোসাদ ছাড়া ইসরায়েলের অস্তিত্ব কল্পনা করা এক দুঃস্বপ্ন।
এই মোসাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা ব্যর্থতার জোর অভিযোগ উঠেছে। এর কারণ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গত ৭ অক্টোবর আকস্মিক ইসরায়েলে হামলা চালায়। হামাসের যোদ্ধারা মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থান ও অবকাঠামো লক্ষ্য করে ৫ হাজার রকেট ছোড়ে। হামাসের আকস্মিক আক্রমণে প্রাথমিকভাবে অনেকটাই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল ইসরায়েল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লেগেছে দেশটির। তবে ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও দেশটির শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা কেন এই হামলা আগেই টের পেতে ব্যর্থ হয়েছে, তা নিয়ে কথা উঠেছে।
গাজার সীমান্তে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। রয়েছে ক্যামেরা নজরদারি। আছে মোশন সেন্সরও। ফলে সীমান্তের আশপাশে কোনো প্রাণী নড়াচড়া করলেই ধরা পড়ে যায়। এমনকি মাটির নিচ দিয়ে গর্ত বা সুড়ঙ্গ কেটে যাতে কেউ সীমানা টপকে যেতে না পারে, তার জন্য মাটির নিচেও রয়েছে সেন্সর-যুক্ত দেওয়াল। এছাড়া সীমান্তরক্ষী বাহিনীর টহলদারি তো আছেই। সেই সঙ্গে রয়েছে ঘরোয়া গোয়েন্দা সংস্থা ‘শিন বেত’। বিশ্বখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ, যারা যে কোনো দেশ ও সন্ত্রাসবাদী সংস্থার হাঁড়ির খবর রাখার জন্য খ্যাত। তাছাড়া ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিটি শাখার আলাদা আলাদা গোয়েন্দা বিভাগ রয়েছে। তাদের হাতে আছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি। টেলিফোন-ইমেইলে আড়িপাতা, উপগ্রহ মাধ্যমে আকাশপথে নজরদারি চলে নিয়মিত। এত কিছুর পরও, গত শনিবার কিচ্ছুটি টের পায়নি ইসরায়েল। সীমান্তেও বেড়া ভেঙে, সমুদ্রপথে, প্যারাগ্লাইডারে চড়ে, গাজা ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েছিল তারা। ব্যাপক হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি থানা, সেনাচৌকি খালি করেছে, বন্দি করে নিয়ে এসেছে বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা ও সেনাসদস্যকে।
উল্লিখিত ঘটনায় মোসাদ নিয়ে অতিকথনই প্রকাশ পায়।
পরিশেষে মোসাদ নিয়ে একটি বিখ্যাত গল্প—
গোয়েন্দা বা গুপ্তচরের আসল কথা গোপন না থাকলে সমূহ সর্বনাশ। গুপ্তচরের আসল কাজ বৈষ্ণব কবিতার পিরিতির মতো। গোপন পিরিতি গোপনে রাখিবি সাধিবি মনের কাজ। ইসরাইলের গুপ্তচর বিভাগ গোপনে কাজ সারতে, শোনা যায়, খুবই পটু।
ইসরাইলের গুপ্তচর বিভাগের বড় কর্তা একদিন গোপনে ডেকে পাঠালেন অস্কার লেভাস্ট নামে একজন অধীনস্থ গুপ্তচরকে। গোপনে বললেন, ‘লেভাস্ট, আজই তোমাকে নিউ ইয়র্ক যেতে হবে। এই নাও প্লেনের টিকিট।’ বড়কর্তা গোপনে টিকিটখানা লেভাস্টের হাতে দিলেন। বললেন, ‘সেখানে গিয়ে কোন হোটেলে উঠবে, তা এই গোপন খামের মধ্যে লেখা আছে। নাও।’
টিকিট এবং খাম লেভাস্ট গোপন পকেটে রেখে দিল। বড় কর্তা বললেন, ‘ঐ হোটেলে আমাদের একজন গোয়েন্দা আছে। তার নাম অ্যাডগার ম্যাগনিন। সে যে আমাদের গোয়েন্দা—সেটা সে জানে, আমি জানি, আর এ মুহূর্তে তুমি জানলে। খুব গোপন। তুমি গিয়ে অ্যাডগার ম্যাগনিনের ডান কানের কাছে মুখ নিয়ে গোপনে ফিসফিস করে বলবে, স্কাই ইজ ব্লু অ্যান্ড ট্রিজ আর গ্রিন। তারপর অ্যাডগার গোপনে তোমাকে একটা গোপন কাজ করতে বলবে। তুমি সেটা গোপনে সেরে গোপনে চলে আসবে। ব্যস।’
বড় কর্তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললেন লেভাস্ট। কিন্তু নিউ ইয়র্ক হোটেলে এসে একটা গোপন বিপদে পড়লেন। রিসেপশনিস্ট খাতাপত্র খুলে বললেন, আমাদের হোটেলে এখন দুই জন অ্যাডগার ম্যাগনিন আছেন। একজন থাকেন তেতলায় ৪২ নম্বর রুমে। আরেক জন থাকেন ৬২ তলায় ৬ হাজার ১৩ নম্বর রুমে।
আর শুনে কাজ নেই। আগে গোপনে তেতলায় ৬২ নম্বর রুমে গিয়ে দেখা যাক। সেখানে যেতে কোনো অসুবিধা হলো না। রুমের মধ্যে অ্যাডগার ম্যাগনিন আছেন। তিনি সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন লেভাস্টকে। ম্যাগনিনের ডান কানের কাছে মুখ নিয়ে গোপনে ফিসফিস করে বললেন, ‘স্কাই ইজ ব্লু অ্যান্ড ট্রিজ আর গ্রিন!’
শুনে ম্যাগনিন হো হো করে হাসলেন। আপনি ইসরাইলের গুপ্তচর অ্যাডগার ম্যাগনিনকে চাইছেন তো? তিনি ৬২ তলায় ৬ হাজার ১৩ নম্বর রুমে থাকেন!