ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের পাওনা পরিশোধে ১০ দিনের বেশি বিলম্ব হলে বিপিসির ওপর চাপ বাড়বে * ফের লোডশেডিং হতে পারে রোববার থেকে
জ্বালানি পণ্যের মধ্যে তেলের চেয়ে আপাতত গ্যাস সংকট নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন সরকার। বর্তমানে দেশে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলসহ ৫০ দিনের জ্বালানি তেলের মজুত আছে।
ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনার চুক্তিও করা আছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত চূড়ান্ত করা আছে তেলের আমদানি শিডিউল। সবমিলিয়ে বর্তমানে জ্বালানি তেল মজুত আছে (নোঙর করা জাহাজ ছাড়া) সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে শুধু ডিজেলই আছে প্রায় ৪ লাখ ৪ হাজার মেট্রিক টন এবং ফার্নেস অয়েল ১ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। তবে অকটেন ও পেট্রোল নিয়ে কোনোভাবেই চিন্তিত নয় সরকার। কারণ দেশীয় রিফাইনারিগুলোতে বর্তমানে চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে অকটেন আর পেট্রোল।
কিন্তু তেলের চেয়ে এই মুহূর্তে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলএনজি) আমদানি নিয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে সরকার। এখানেই দুশ্চিন্তা বেশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যেতে পারেনি।
যার কারণে দেশব্যাপী লোডশেডিং বাড়াতে হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস আমদানি সংক্রান্ত যেসব চুক্তি আছে সেগুলো থেকে আপাতত গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। তবে এই সংকট আরও প্রকট হতে পারে বলে ইতোমধ্যে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীরা।
কারণ যাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে আন্তর্জাতিকভাবে গ্যাস সংকটের কারণে তাদের অনেকেও এখন আর প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে কিংবা দীর্ঘমেয়াদি হলে এই সংকট দিন দিন বাড়তে থাকবে।
এক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় গ্যাস পাওয়া যাবে না বলেও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। যদিও সরকার দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। জানা গেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশীয় কূপ থেকে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি আরও বেশকিছু প্রকল্প হাতে আছে বাপেক্সের।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সময়ের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১১ শতাংশ। জ্বালানি পণ্যের জন্য আগে ৩৯৬ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হলেও তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮৩৭ কোটি ডলারে। একই সময়ে আগে পরিশোধ করা হয়েছে ৩৭৬ কোটি ডলার এবং সর্বশেষ পাঁচ মাসে পরিশোধ করা হয়েছে ৭৭৭ কোটি ডলার।
এই অবস্থায় ব্যাপক চাহিদা থাকলেও ডলার সংকটের কারণে এলএনজি আমদানি করতে পারছে না জ্বালানি বিভাগ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পর্যাপ্ত এলএনজি না থাকায় সরবরাহকারীরা দিন দিন এই পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলছে। ব্যাংকগুলোও এখন এলএনজি আমদানির জন্য এলসি খুলতে ভয় পাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, যদি এলসি খোলার পর ওই কোম্পানি এলএনজি আমদানি করতে না পারে সেজন্য কিছু কিছু ব্যাংক এলসি খুলতে ভয় পাচ্ছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, এ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ৮টি তেলবাহী জাহাজ নোঙর করবে। ১৩ জুলাই বন্দরে ভিড়েছে ২টি জাহাজ। বিপিসি জানিয়েছে, জ্বালানি তেলের মধ্যে একমাত্র ডিজেল আর ফার্নেস অয়েল নিয়ে তাদের শঙ্কা বেশি। বিপিসি বলছে, তেল সরবরাহকারী বিদেশি সংস্থাগুলোর পাওনা পরিশোধ নিয়ে এখনো বড় কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি।
নিয়ম হলো বিদেশ থেকে আসা তেল বিপিসির ভান্ডারে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পেমেন্ট করতে হয়। কিন্তু কয়েক মাস ধরে ডলার সংকটের কারণে এই পাওনা পরিশোধে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত দাম পরিশোধ করতে গিয়ে সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ দিন বিলম্ব হয়েছে। তার মতে, এটি এখনো সহনীয়। তবে এর চেয়ে বেশি দেরি হলে তখন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, জ্বালানি পণ্য আমদানিতে ডলারের কোনো সংকট এখন নেই। কারণ ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ডলার দিয়ে আগে জ্বালানি পণ্যসহ নিত্যপণ্য ও ওষুধ সামগ্রীর এলসি খুলতে। বিলাসী বা অপ্রয়োজনীয় পণ্যে ডলার দেওয়া নিরুৎসাহিত করতে। এছাড়া ব্যাংকগুলো চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দিচ্ছে।
জ্বালানি তেল আমদানির দেনা পরিশোধে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার দিতে পারছে না-বিপিসির এমন চিঠি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ‘এটি একটি বা দুটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাময়িক সময়ের জন্য হতে পারে। ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে না। বিপিসি চিঠি দিয়েছে সতর্ক হওয়ার জন্য। তাদের চিঠি পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি তদারকি করছে।’
এদিকে বৃহস্পতিবার দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন। তাদের মতে, ঢাকায় এখনো মানুষজন কম। অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শপিংমলগুলো ঠিকমতো খোলেনি। যার কারণে চাহিদা কম থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও করতে হচ্ছে কম।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বুধবার পর্যাপ্ত গ্যাস থাকার পরও ডিমান্ড কম থাকায় ১২৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে যাওয়া লাগেনি। তবে ঈদের ছুটি শেষে পুরোদমে সবকিছু সচল হবে রোববার থেকে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিদ্যুতের চাহিদাও তখন বাড়বে। ফলে ফের রেশনিং পদ্ধতিতে সরকার লোডশেডিংয়ের পথে হাঁটবে।
পিডিবি সূত্র জানায়, বুধবার তারা যে পরিমাণ গ্যাস পেয়েছে সেটি দিয়ে ৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালিয়েছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসভিত্তিক ১১ হাজারের বেশি মেগাওয়াটের ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। পর্যাপ্ত গ্যাস থাকলে এই ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব গ্যাস থেকে। আর সেটা করা গেলে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে আরও কমানো সম্ভব ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম সম্প্রতি বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘যুদ্ধাবস্থা’ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, সেপ্টেম্বরের পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তিনি আশা করছেন এই সময়ের পর জাতীয় গ্রিডে আরও ২ হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হতে পারে।’
এ প্রসঙ্গে গত ৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, ‘জ্বালানি সংকটের কারণে এই মুহূর্তে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে দুই হাজার মেগাওয়াটের মতো। আমরা যদি বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে পারি তাহলে ঘাটতি ৫শ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
অফিস সময় কমিয়ে আনার কথা ভাবা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি ভাবছি সপ্তাহে একদিন হোম অফিস চালু করা যায় কিনা। পাশাপাশি এখন করোনা সংক্রমণও বাড়ছে। সবাই মেনে চললে, ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হবে না। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট প্রতিদিন প্রয়োজন। সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে, এই চাহিদা ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।’