গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক এমডি ড. ইউনূসের পক্ষে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠানো হয়েছে। এতে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত আইনের নানা ভুল ব্যাখ্যা এবং অসত্য তথ্য দেওয়া হয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংক কোনো বেসরকারি ব্যাংক নয়, এটি একটি Statutory Public Authority বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ/প্রতিষ্ঠান। সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ বলতে সেসব প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়, যে প্রতিষ্ঠান কোনো নির্দিষ্ট আইনের দ্বারা সৃষ্ট এবং আইনে উল্লিখিত বিধানাবলির আলোকে ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়।
বিজ্ঞাপন
গ্রামীণ ব্যাংক ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারীকৃত অর্ডিন্যান্স The Grameen Bank Ordinance, 1983 (Ordinance NO. XLVI OF 1983 ) -এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। আইনটির ধারা ২-এ বলা আছে, আইনটি সেসব গ্রামীণ এলাকায় কার্যকর হবে, যেসব এলাকা সরকার কর্তৃক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
১৯৮৩ সালের আইনের ধারা ৪(৪)-এ বলা আছে, সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ব্যাংক কম্পানিজ আইন অথবা ব্যাংক কম্পানিজ সম্পর্কিত অন্য কোনো আইনের কোনো বিধান গ্রামীণ ব্যাংকে প্রয়োগ করতে পারবে।
এই আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী আইনটি একটি বিশেষ আইন। কারণ এই আইনের ধারা ৩-এ এই আইনের প্রাধান্য (overridding clause) রয়েছে। ধারা ৩-এ বলা হয়েছে, অন্যান্য আইনে বিধানাবলি যা-ই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধান কার্যকর হবে।
৬০ বছরের বেশি বয়সে গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্বে থাকা প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘গ্রামীণ ব্যাংক এমন একটি ব্যাংক, যার ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক এর ঋণগ্রহীতারা। একটি আলাদা আইনের মাধ্যমে কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য সন্নিবেশ করে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ফলে অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় এর পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে একটি চুক্তির অধীনে। এই নিয়োগের জন্য কোনো বয়সসীমা আইনে বা পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে উল্লেখ ছিল না। ’
ব্যাংকের পেইডআপ ক্যাপিটাল বা পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতারা এর কত ভাগ মালিক, এর সঙ্গে ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) পদে নিয়োগ কিংবা ওই পদের মেয়াদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমডি পদে নিয়োগ এবং পদের মেয়াদের ক্ষেত্রে একমাত্র আইনের বিধানই প্রযোজ্য হবে। অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের যে পার্থক্যের কথা বলা হচ্ছে, ব্যাংকের এমডির চাকরির মেয়াদের সঙ্গে এই পার্থক্যের কোনো সম্পর্ক নেই।
বরং সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের মতো গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদটি একটি পূর্ণকালীন চাকরির পদ এবং এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদটি অন্য সব ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদের মতো মেয়াদভিত্তিক ও অপূর্ণকালীন।
ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় এর পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে একটি চুক্তির অধীনে। এই নিয়োগের জন্য কোনো বয়সসীমা আইনে বা পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে উল্লেখ ছিল না। ’
এই বক্তব্য অসত্য। কারণ ১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংকের অর্ডিন্যান্সের ধারা ১৪(১) অনুযায়ী এই ব্যাংকের এমডির নিয়োগ চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমডি পদে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য একটি সিলেকশন কমিটি থাকে এবং সেই বাছাইয়ের ভিত্তিতে ব্যাংকের বোর্ড এমডি নিয়োগ করে। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানও নিয়োগ করে সরকার। গ্রামীণ ব্যাংক একটি সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান বলেই আইনে এই নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতেই রাখা হয়েছে।
১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক আইন অনুযায়ী ব্যাংকের এমডি পদটি একটি সার্বক্ষণিক পদ এবং তিনি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও)। আইনের ধারা ৯(২) অনুযায়ী এমডি পদাধিকারবলে ব্যাংকের পরিচালক, তবে এমডি বোর্ডে ভোট প্রদান করতে পারবেন না। আইনের ধারা ১০(২) অনুযায়ী কোনো কারণে চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে সরকার এমডি ছাড়া অন্য যেকোনো পরিচালককে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে।
আইনের উল্লিখিত বিধানাবলি পড়লে এটি পরিষ্কার যে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদটি একটি সার্বক্ষণিক চাকরি।
যেকোনো সার্বক্ষণিক পদের একটা মেয়াদ থাকে। ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশে এমডি পদের অবসরের সময়সীমা উল্লেখ না থাকলেও এটি নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
কারণ ১৯৮৩ সালের আইনের ধারা ৪(৪)-এ বলা আছে, সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ব্যাংক কম্পানিজ আইন অথবা ব্যাংক কম্পানিজ সম্পর্কিত অন্য কোনো আইনের কোনো বিধান গ্রামীণ ব্যাংকে প্রয়োগ করতে পারবে। সরকারের এই ক্ষমতা প্রয়োগ করা ছাড়াও
Interpretation of Statutes -এর সাধারণ নীতি অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য ব্যাংকের এমডি পদের মেয়াদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির চাকরির মেয়াদ ধরতে হবে। অন্য সব ব্যাংকে এই মেয়াদ তখন ছিল ৬০ বছর। এ ছাড়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২(১)-এ আইনের যে সংজ্ঞা আছে, তাতে প্রথা বা রীতিকেও আইন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ফলে অন্যান্য ব্যাংকের চাকরির বিধান প্রথা হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের আইনের ধারা ৮(২) অনুযায়ী ব্যাংক তার কার্যাবলি পরিচালনার ক্ষেত্রে সব সময়ই জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। এই বিধানের আওতায় ব্যাংকটির প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্তে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি প্রয়োজন।
এ ছাড়া The General Clauses Act 1897 -এর বিধান অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি এবং নিয়োগকৃত পরিচালকদের নিয়োগ সরকার বাতিল করতে পারে। কারণ
General Clauses Act 1897- এ বলা আছে যে কর্তৃপক্ষ নিয়োগ প্রদান করতে পারে, সেই একই কর্তৃপক্ষ নিয়োগ বাতিল করতে পারে।
ড. ইউনূসের বিবৃতিতে পদ্মা সেতু নিয়ে তাঁর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করা হয়নি মর্মে যে দাবি করা হয়, এই বিষয়ে ড. ইউনূসের কাছে বাংলাদেশের জনগণের প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কেন খরচ করেছিলেন? যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম তিনি কেন নিয়োগ করেছেন—এটি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ জানে।