দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি পার করছে বাংলাদেশ। দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যাংকে থাকা সঞ্চয়ও ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে ব্যাংক আমানতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ব্যাংক খাতে শ্লথ হয়ে এসেছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে ব্যাংকের আমানত কমছে সবচেয়ে বেশি।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব গ্রামের মানুষের সঞ্চয়ের ওপর পড়েছে বলে মনে করেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। তিনি বলেন, আগে রেমিট্যান্সের অন্তত ২০ শতাংশ অর্থ ব্যাংক হিসাবে আমানত হিসেবে জমা থাকত। কিন্তু এখন রেমিট্যান্সের ৫ শতাংশ অর্থও ব্যাংকে আমানত হিসেবে থাকছে না। বিদেশ থেকে অর্থ আসার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাহক পুরো টাকাই তুলে নিচ্ছেন। জীবনধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের ব্যাংক খাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট আমানত ছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ছিল গ্রামীণ আমানত, কিন্তু ডিসেম্বরে এসে এর পরিমাণ ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাত্ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর গ্রামীণ আমানত কমে গেছে ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি খারাপ না হলে দেশের ব্যাংক খাতে আমানত সব সময়ই প্রবৃদ্ধির ধারায় থাকে। আবার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। গ্রামে ব্যাংকের আমানত না বেড়ে উলটো কমে যাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন।
গ্রামাঞ্চল থেকে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের প্রধান উত্স হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং। বিশেষ ধরনের এ সেবা চালুর পর থেকেই প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল গ্রামীণ আমানত। কিন্তু গত বছরের শেষ তিন মাসে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আমানত স্থিতি ৫০৫ কোটি টাকা কমে গেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এজেন্টদের মাধ্যমে ৩০ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ হয়। ডিসেম্বর শেষে সেটি ৩০ হাজার ১৫৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। এজেন্ট ব্যাংকিং আমানতের ৭৯ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের।
দেশে গত বছরের শুরু থেকেই দ্রব্যমূল্য ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় সরকার। হঠাত্ করে জ্বালানির অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশে প্রতিটি পণ্য ও সেবার দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। সরকারি হিসাবেই গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর ডিসেম্বরে হয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। যদিও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে ১০০ শতাংশেরও বেশি।
দেশের সর্ববৃহত্ ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী জানান, ইসলামী ব্যাংকে এমন অনেক গ্রাহক আসছেন, যারা তাদের দীর্ঘদিনের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। অনেকে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই দীর্ঘমেয়াদি আমানত (ফিক্স ডিপোজিট/ ডিপিএস) তুলে নিতে আসছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলছেন, দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সঞ্চয় ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। তবে অল্প কিছু গ্রাহক আতঙ্কিত হয়েও আমানত তুলে নিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ৭৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ শহরাঞ্চলের। বাকি ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ এসেছে ব্যাংকের গ্রামীণ শাখাগুলোর মাধ্যমে। গত বছরের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ঐ সময় শহরাঞ্চলে ১৫ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা বাড়লেও গ্রামে ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকার আমানত কমে গেছে।